বরুণ গাছ, পাতা, ফুলের নানাবিধ ভেষজ গুণাগুণ

এই গাছটি সমগ্র ভারতে অল্পবিস্তর জন্মে, তবে সাধারণতঃ মালাবার, কর্ণাটক, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, ২৪ পরগণা, হাওড়া, হুগলী সব জেলাতেই অল্পবিস্তর দেখতে পাওয়া যায়, তবে হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলে যে পাওয়া যায় না তা নয়।

মাঝারি ধরনের গাছ, প্রচুর শাখা-প্রশাখা হয়; গাছের ছাল (ত্বক) ধূসর, যাকে বলে ছাই রঙের, কিন্তু ছালে সাদা সাদা বিন্দু, দাগ আছে, স্বাদে তিক্ত, দেখতে অনেকটা সপ্তপর্ণী গাছের (যাকে আমরা চলতি কথায় ছাতিম বলি) ছালের মত। এক বোঁটায় (বৃন্তে) তিনটি পাতা হয় (বেলপাতার মত) কিন্তু আকারে এর থেকে অনেক বড়, মাঝের পাতার আগাটা (অগ্রভাগটা) সরু ও লম্বা, ফুলের পাপড়ি ঘি রঙের, তার কেশরগুলি দেখতে বিড়ালের গোঁফের মত।

মাঘ-ফাল্গুনে গাছের পাতা প’ড়ে আবার নতুন পাতা হয়, তারপর ফুল ও ফল। ফলগুলি আকারে কয়েৎবেলের মত আর রঙও সেই রকম। একে সংস্কৃতে অশ্মরীঘ্ন, বরুণ, বরুণা; বাংলায় বরুণ, বরুণ বৃক্ষ; হিন্দীতে বরুণ, বরুণ, বরুণা বলে। এর বোটানিক্যাল নাম: Crataeva nurvala Buch.-Ham., পূর্বে এটির নাম ছিল Crataeva religiosa Hook. f. & Thoms.: ফ্যামিলী। Capparidaceae. ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ—গাছের পাতা, ছাল (ত্বক) ও ফল।

বরুণ গাছ-এর উপকারিতা:

প্রথমেই বলে রাখি যে, বরুণ গাছের ছাল, পাতা ও ফুলের ব্যবহার অত্যন্ত প্রাচীন, তবে দেখা যায় যে, যত শিশু-ভেষজ আছে তার মধ্যে বরুণের ব্যবহারের উল্লেখ বহু ক্ষেত্রে। তাই এটারও গবেষণার ক্ষেত্র আছে, শুধু তাই নয়, প্রয়োজনও আছে। এটি সামগ্রিকভাবে কাজ করে রসবহস্রোতে।

১. অগ্নিমান্দ্যে: বায়ু, পিত্ত, কফ এদের যেকোন একটির অথবা দুটি বা তিনটি দোষের বিকার জন্যই হোক না কেন, বাহ্যত: প্রত্যক্ষ করা যাবে যে যাঁদের মূত্র কমে যাবে, আর ক্ষিধেও কম হবে, সেক্ষেত্রে বরুণছাল ৫ গ্রাম দুকাপ জলে সিদ্ধ করে আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে ওই ক্বাথ ৪ ঘণ্টা অন্তর ৪ বারে খেতে হবে। এর দ্বারা ওই অগ্নিমান্দ্যটা চলে যাবে।

আরো পড়ুন:  ছোট ঝুনঝুনা দক্ষিণ এশিয়ায় জন্মানো ভেষজ বিরুৎ

২. রসবাতে: এ রোগের বিস্তৃত লক্ষণ হচ্ছে গাঁটে গাঁটে ব্যথা, এমনকি পায়ের তলায়ও ব্যথা ও ফোলা; এক্ষেত্রে শঙ্ক বরুণ গাছ-এর পাতা ৫।৭ গ্রাম ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে, আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে ওই জলটায় আধ গ্রাম (৫০০ মিলিগ্রাম) শুঠের গুঁড়া (শুল্ক আদা চূর্ণ) মিশিয়ে সকালে ও বৈকালে দু’বারে খেতে হবে। এইভাবে ২। ৩ দিন খেলে ওই ব্যথা ও ফোলা দুই-ই কমে যাবে।

৩. গ্রথিস্ফীতিতে: যাঁদের সান্নিপাতিক দোষে গলার দু’ধারের গ্লান্ড ফোলে বরুণছাল ৫ গ্রাম ও প্রচলিত শ্বেত পূর্ণবার মূল (Trianthema portulacastrum) মূল একসঙ্গে থেতো করার পর তাকে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ ক’রে আন্দাজ দেড় কাপ থাকতে নামিয়ে, ছে’কে সেই জলটা সকালের দিকে অর্ধেকটা ও বৈকালের দিকে বাকী অর্ধেকটা খেতে হবে। এর দ্বারা গ্রন্থিস্ফীতিটা কমে যাবে।

৪. পাথুরী রোগে: এটা পিত্ত এবং শ্লেষ্মর বৈকারিক বিকৃতিরুপ। পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রে এটাকে বলা হয় স্টোন (Stone) হয়েছে। সে কিডনিতে অথবা পিত্তের থলিতে কিম্বা মুত্রবস্তিতে জন্মে। এক্ষেত্রে বরুণছাল ১০ গ্রাম একটু কুটে নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছে’কে সেই জলটা সকালে ও বৈকালে দুবারে খেতে হবে। এইটা তিন/চার দিন খাওয়ার পর থেকে ওই পাথুরীগুলি কণার আকারে বেরুতে শুরু হবে।

৫. চুলকণায়: যেক্ষেত্রে পিত্তবিকারজনিত কারণে সমস্ত শরীরে জ্বালা, সেক্ষেত্রে বরুণছাল ৫ গ্রাম ও গোক্ষুর বীজ (Tribulus terrestris) ৫ গ্রাম একসঙ্গে কুটে নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এককাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে ওই ক্বাথ সকালের দিকে খেতে হবে। এইটা ৪। ৫ দিন খাওয়ার পর গায়ের জ্বালারও উপশম হবে এবং চুলকণাও আর থাকবে না।

বাহ্য ব্যবহার

৬. চক্ষু রোগে: অনেক সময় বাজারের প্রচলিত কাজল চোখে পরেন অথবা কাজলের পেনসিল, চোখে টেনে পটলচেরা চোখের নমুনা করেন। অনেক সময় এটার পরিণাম খুবই ভয়াবহ হয়। এমন ক্ষেত্র উপস্থিত হলে বরুণ গাছ-এর ছাল চূর্ণ ২ গ্রাম ৭। ৮ চামচ গরম জলে ভিজিয়ে রেখে সেটাকে পর, ন্যাকড়ায় দু/তিন বার ছে’কে নিয়ে সেই জলটি দিয়ে সকালে ও বৈকালে দু’বার চোখের পাতাটা মুছে দিতে হবে। এর দ্বারা ওই অসুবিধেটা চলে যাবে।

আরো পড়ুন:  ক্ষুদিজাম বাংলাদেশের বনাঞ্চলে জন্মানো ভেষজ বৃক্ষ

৭. মেছতায়: এটা মখেই হয়; আকারে দেখতে যেন আন্দামান দ্বীপের মত আবছা কালো একটা দাগ। এটা কিন্তু ছত্রাক জাতীয় ব্যাধি। এই রোগ সারাতে হলে বরুণ ছাল ছাগল দুধে ঘ’ষে প্রত্যহ একবার ওই দাগটায় লাগাতে হবে। ৪। ৫ দিন লাগানোর পর থেকে ওই কালো দাগটা আস্তে আস্তে হালকা হতে সরু করবে। কয়েকদিন পর থেকে একদিন অন্তর লাগাতে হবে। ১৫। ২০ দিনের মধ্যে ওটা সেরে যাবে।

CHEMICAL COMPOSITION

Crataeva nurvala Buch-Ham

Bark contains :- Saponin and tannin. Root bark contains : — Lupeol; B-sitosterol and varunol.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ৭৯-৮১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!