পদ্মকাঠ ( Prunus puddum) গাছের কাঠ শীতল, তিক্ত পুষ্টিকর, রক্তস্তম্ভক, ছর্দি নিগ্রহণ, স্তম্ভন, বেদনাস্থাপক, বর্ণকারক, গর্ভস্থৈর্যকর ও জ্বরঘ্ন। পদ্মকাষ্ঠের কাঠে ও ছালে হাইড্রোসাইনিক এসিড আছে। এটি অত্যন্ত বিষাক্ত। অল্প মাত্রায় ঔষধের কাজ করে, বেশি মাত্রায় খেলে শারীরিক ক্ষতি হয়। এর বিষাক্ত শক্তিটি স্তম্ভনকারক এবং তিক্ত পৌষ্টিক গুণকারকের কারণ হয়। বর্ণ বিকার, কণ্ডু, কুষ্ঠ, বিসর্প, দাহ প্রভৃতিতে এই কাঠের বাহ্য প্রলেপ হিতকর।
অগ্নিমান্দ্য, আমাশয়-শৈথিল্য, বমন, তৃষ্ণা, রক্তপিত্ত, জ্বর, হৃৎ-দৌর্বল্য, শুক্রদৌর্বল্য, গর্ভস্রাব, গর্ভাশয়-দৌর্বল্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মাত্রায় কাঠের চূর্ণ ব্যবহার্য। হিক্কা ও শ্বাসে মধুর সঙ্গে কাঠের চূর্ণ মিশিয়ে চেটে খেতে দেওয়া হয়। পদ্মকাঠ সর্বদা নতুন ব্যবহার করা উচিত। পুরাতন হলে কাঠের বীর্যশক্তি অক্ষুন্ন থাকে না। তাছাড়া এটির ক্বাথ করে ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এর মধ্যে যে উড়নশীল তেল থাকে, সেটি চলে যায়। কাঠচূর্ণ ঈষদুষ্ণ জলে ১০/১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে সেই জল ব্যবহার্য। বীজের মজ্জা অশ্মরী ও শর্করা নাশক । প্রধানভাবে এটি কাজ করে রসবহ স্রোতে। পাহাড়ীয়া অঞ্চলে গরু-মহিষের পা মচকে গেলে এই গাছের ছাল বেটে প্রলেপ দেয়, তাতে ফোলা ও যন্ত্রণা দুই-ই কমে।
পদ্মকাঠ গাছ-এর প্রয়োগ:
পদ্মকাঠ গাছ-এর ছালে ও কাঠে হাইড্রোসাইনিক এসিড আছে। এটি অল্প মাত্রায় ঔষধ, বেশি মাত্রায় বিষ। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।
১. মোহ হলে: আমরা যাকে চলতি কথায় বলে থাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। এটা কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে আসে না, একটা রোগের উপসর্গ হয়েই আসে। এই যেমন প্রবল জ্বর, তার সঙ্গে বমি আর মাথার যন্ত্রণা হলে এমন একটা অবস্থা আসে, যখন সামনে কেউ থাকলেও চিনতে পারে না, উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরে যায়, মাথার যন্ত্রণা এমন হয় যে, মনে হবে মাথার ভিতরটা চৌচির হয়ে ফেটে যাবে, তার পরবর্তী অবস্থা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া; এক্ষেত্রে জ্বরের আধিক্য কমানোর ব্যবস্থা করা প্রাথমিক কর্তব্য, তারপর অন্যান্য উপসর্গ। এই ধরনের ক্ষেত্র হলে পদ্মকাঠ চন্দন ঘষা পাথরের পিড়িতে ঘষতে হবে। ঠিক চন্দনের মত দেখতে হলে সেইটা এক বা দুই চামচ নিয়ে অল্প জল ও চিনি সহ খেতে দিতে হবে। এটাতে খুব শীঘ্রই মোহটা কেটে যাবে, জ্বরের কোপও কমতে থাকবে এবং নিদ্রা এসে যাবে।
২. খোস, দাদ, চুলকানিতে: ৩/৪ গ্রাম পদ্মকাষ্ঠ চূর্ণ অথবা থেঁতো করে এক কাপ গরম জলে রাত্রে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরদিন সকালে গোলানো জল ঘেঁকে সকালে ও বিকালে দুই বারে খেতে হবে। একই সঙ্গে পদ্মকাষ্ঠটি চন্দনের মত ঘষে আক্রান্ত স্থানে দুই বার করে লাগালে কয়েক দিনের মধ্যে ওই রোগের উপশম হবে এবং এটাতে সেরেও যাবে।
৩. রক্তপিত্তে: যাদের ঊর্ধ্বগ রক্তপিত্তে তাদের ক্ষেত্রে পদ্মকাঠের চূর্ণ ১ গ্রাম, রক্তচন্দন ঘষা ১ চা-চামচ, চিনি ২ চা-চামচ ও ২০/২৫ গ্রাম আতপ চাল ধোয়া জল ১ কাপ একত্রে মিশিয়ে সকালে একবার এবং ঐভাবে বিকালে একবার খেতে হবে। কয়েকদিন খেলে অসুবিধেটা চলে যায়।
৪. গর্ভসংরক্ষণে: কারো পর পর ৩/৪ বার আপনা থেকেই গর্ভপাত হয়ে যায়, তাকে Habitual abortion বলা হয়। এই গর্ভপাতের কারণ অনেক। তবে যেক্ষেত্রে গর্ভিণীর গর্ভাশয়ের কোন অস্বাভাবিকতা অথাৎ গর্ভাশয়ের মধ্যে সূত্রময়গুল্মের (Uterine fibroid) উৎপত্তি, গর্ভাশয়ের পশ্চাদাবর্তন (retrovertion), গর্ভাশয়ের গঠনে ত্রুটি ও আংশিক ক্ষয় (hypoplastic uterus), গর্ভাশয়ের দ্বিত্ব (double uterus), গর্ভাশয় গ্রীবার অযোগ্যতা (Cervical incompetence) প্রভৃতি থাকে না; গর্ভিণী ফিরঙ্গ (syphilis), মধুমেহ (diabetes mellitus), রক্তহীনতা (anaemia), জীর্ণ বৃক্কশোথ (chronic nephritis) প্রভৃতি রোগেও আক্রান্ত নন; স্ত্রী বীজ ও শুক্রকীটের রোগও (Faults in the fertilised ovum or spermatozoon) নেই ; এছাড়া গর্ভাবস্থায় অনিয়মিত আহার ও বিহারেরও অর্থাৎ অতিরিক্ত মৈথুন, ব্যায়াম, শ্রমজনক কাজ, যানে আরোহণ; অনুচিতভাবে ভোজন, শয়ন, উপবেশন; ক্ষুধা, পিপাসা প্রভৃতির বেগধারণ কোন ইতিহাস পাওয়া যাচ্ছে না; অথচ গর্ভপাত হয়েই যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে সাধারণতঃ যে কারণটি বিশেষভাবে সামনে আসে, তা হলো অন্তঃস্রাবী গ্রন্থির ক্রিয়াহানি (Hormonal deficiencies)— Progesterone, Oestrogen, Gonadrotrophin প্রভৃতির স্বল্পতা, বিশেষতঃ প্রথমটির স্বল্পতাই উল্লেখযোগ্য।
আরো পড়ুন: পদ্মকাঠ পাহাড়িঞ্চলে জন্মানো ভেষজ বৃক্ষ
এই যে ক্ষেত্র, গর্ভরক্ষার জন্য নিম্নলিখিত যোগটি বেশ কিছুকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফলও পাওয়া গেছে। যে মাসে গর্ভের সঞ্চার হয়েছে জানা যাবে অর্থাৎ ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেলেই কোন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিকভাবে জেনে নিতে হবে এটি গর্ভ কিনা, সে মাস থেকেই অষ্টম মাস পর্যন্ত যোগটি ব্যবহার করলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে আহার ও বিহার করতে পারলে গর্ভপাতের আশংকা প্রায়ই থাকে না।এক্ষেত্রে পদ্মকাঠ ঘষা ১ চা-চামচ ও রক্তচন্দন ঘষা ১ চা-চামচ অল্প চিনির সঙ্গে মিশিয়ে প্রত্যহ একবার করে খেতে হবে।
৫. রক্তার্শে : কারো কারো যখন-তখন রক্তস্রাব হয়, কারোর বা ক্রমাগত রক্ত পড়ে, উভয় ক্ষেত্রেই রক্তার্শ। সেইসঙ্গে কোষ্ঠবদ্ধতা, গুহ্যদেশ ও তৎসংলগ্ন আক্রান্ত স্থানে মাঝে মাঝে যন্ত্রণা, অত্যধিক রক্তস্রাবের জন্য রক্তহীনতা, দুর্বলতা, ক্ষুধামান্দ্য প্রভৃতি এসে হাজির হয়। প্রথম থেকে সাবধানতা অবলম্বন করলে বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হয় না।
এক্ষেত্রে পদ্মকাঠ চন্দনের মতো ঘষে ১ চা-চামচ মাত্রায় নিয়ে তাতে আধ কাপ জল ও ২ চা-চামচ চিনি মিশিয়ে শরবতের মতো করে সকালে খালি পেটে একবার এবং ঐভাবে বৈকালের দিকে একবার খেলে কয়েক দিনের মধ্যেই রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এই সঙ্গে চিকিৎসকের মতানুসারে অর্শোঘ্ন কিছু ঔষধ ব্যবহার করলে স্থায়ী ফল পাওয়া যায়।
৬. রক্ত প্রদরে: মাসিক ঋতুস্রাব অধিক মাত্রায় দীর্ঘদিন হতে থাকলে প্রথম থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করা সমীচীন। দীর্ঘদিন বিনা চিকিৎসায় থাকার ফল অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহ হয়। অধিক বয়সে অর্থাৎ রজোনিবৃত্তির (মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব চিরতরে বন্ধ হবার) পরে রক্তস্রাব দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে কাজ করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় পদ্মকাঠ ঘষা ১ চা-চামচ নিয়ে চিনি দিয়ে শরবতের মত করে আধ কাপ আন্দাজ সকালে ও বিকালে ২ বার খেতে হবে। ৮/১০ দিন ব্যবহার করলে উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়। পরে আরও কিছুদিন খেতে হয় একেবারে নিরাময়ের জন্য। তবে ৮/১০ দিন ব্যবহারের পরও কোন উপকার না পেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে চিকিৎসা চলবে ।
৭. যোনিকণ্ডুতে: সাধারণতঃ যেসব মেয়ে নিয়মিতভাবে জননেন্দ্রিয় পরিষ্কার করে, মাসিকের সময় পরিচ্ছন্ন বস্ত্রাদি ব্যবহার করতে চায় না, সাদা স্রাবে যখন-তখন ভোগে।
CHEMICAL COMPOSITION
Prunus cerasoides D-Don. Kernels contain: an oil with a strong flavour of prussic acid. Leaves, twigs, bark & Kernels contain: a cyanogenetic substance. Stem bark contains: flavonone sakuranetin (1%), flavone genkwanin, isoflavone prunetin, isoflavonone padmakastein, glycosides (sakuranin and padmakastin), hydroprunetin and chalkone glycoside (neosakuranin), taxifolin, a dihydroflavonol (padmatin).
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৯, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৫, পৃষ্ঠা, ১৩৩-১৩৫।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।