বৃক্ষারোহী বা ভূমিপ্রসারী লতা, দীর্ঘদিন বেচে থাকে। এটি ভারতের বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে ৩। ৪ হাজার ফুট থেকে ১০।১২ হাজার ফুট পর্যন্ত উচুতে হ’তে দেখা যায়। লতাটি বহু শাখা-প্রশাখা যুক্ত। গাঁদাল বা গন্ধভাদলে (Paederia foetida) পাতার মত হলেও পাতার বোঁটার দিকটা ডিম্বাকৃতি, লম্বায়। ৩। ৪ ইঞ্চি। অক্টোবর থেকে জানুয়ারী মাসের মধ্যে ফল ও ফল হয়। এটিকে সংস্কৃতে মঞ্জিষ্ঠা, বাংলায় মঞ্জিটা, হিন্দীতে মঞ্জিৎ বলে। এর বোটানিক্যাল নাম Rubia cordifolia Linn., ফ্যামিলী Rubiaceae. ব্যবহার্য অংশ—সমগ্র গাছ।
মঞ্জিটা বা মজাঠি-এর উপকারিতা:
দেহের প্রধান প্রধান স্রোতের উপর এটির কার্য হলেও প্রধানভাবে কাজ করে রক্তবহ। স্রোতের যেকোন রোগের উপর প্রয়োগ করা হয়।
১. শোথে: এর উৎপত্তি ও আবাসস্থল চর্মের বিভিন্ন স্তরে ও মাংসে। এর হেতু রক্তবহ স্রোতে পিত্ত ও কফ বিকৃত বায়ু দ্বারা আবদ্ধ বা আবত। সাধারণতঃ এ রোগটির উৎপত্তি হয় লবণ, দই, অম্ল ও তীক্ষ্ম দ্রব্য প্রভৃতি বেশী খেলে। আবার আঘাত জনিতও শোথ হয়। শোথ কিন্তু আগন্তুক কারণেও আসে। এক্ষেত্রে মঞ্জিটা বা মজাঠি ৫ গ্রাম ঘণ্টা দুই আগে ভিজিয়ে রেখে তাকে থেতো করার পর ৪। ৫ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে অর্ধেকটা সকালের ও অর্ধেকটা বৈকালের দিকে খেলে উপরিউক্ত কারণজনিত শোথের উপশম হবে।
২. রক্তজ অতিসারে: বাত-পিত্ত প্রকৃতির লোক, তার উপর পিত্তকর দ্রব্যের প্রতি আসক্তি, অল্প পেটের দোষ থাকলে উপেক্ষা, এসব হ’লে রক্তযুক্ত অতিসার সহজেই দেখা দেয়। এক্ষেত্রে পূর্ববর্ণিত প্রণালীতে মঞ্জিটা বা মজাঠি ক্বাথ প্রস্তুত ক’রে সকালে ও বৈকালে দু’বেলা খেলে কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে যায়। এছাড়া আধ সের পরিমাণ গরম জলে ৫ গ্রাম মঞ্জিঠা থেতো করে রাত্রে ভিজিয়ে পরদিন সকালে ছে’কে, ওটাকে সারাদিনে ৪। ৫ বারে খেতে হবে। এভাবে ২। ১ দিন করলে দাস্তটা বন্ধ হবে এবং সারবে। (দু’ রকমের পদ্ধতিতে খেলে সত্বর উপকার পাওয়া যায়, সম্ভব না হ’লে যেকোন একটি প্রস্তুত করে ব্যবহার করবেন।)
৩. প্রমেহে: সেখানে দেহের লাবণ্যের বিশেষ পরিবর্তন হয় না, তবে প্রস্রাব কখনো বেশী, কখনো কম হয়; হাত-পা আস্তে আস্তে সর হতে থাকে, সামান্য পরিশ্রমে হাঁপ ধরে, এছাড়া হাতে-পায়ের তালুতে ঘাম হয়। এক্ষেত্রে পূর্ববর্ণিত পদ্ধতিতে প্রস্তুত কাথ সকালে ও বৈকালে দু’বেলা খেলে এটির উপশম হবেই।
৪. বিসর্পে: আয়ুর্বেদে বিসর্প শব্দটি বহু অর্থবাচী। পাণ্ডু, কুষ্ঠ, অর্বুদ, খোস-পাঁচড়া, চর্মরোগ, মসুরিকা (বসন্ত) প্রভৃতি রোগের গলিত অবস্থাতেও বিসর্প হয়। অতি দ্রুত বিসর্পিত বা পরিসর্পিত অর্থাৎ ছড়িয়ে যায় বলে এটিকে বিসর্প বলা হয়। পরিসপনশীল যেকোন রোগই বিসর্প নামে চিহ্নিত। বিসর্প মানে কোন একটি বিশেষ রোগকে বোঝায় না। বিসর্প মুখ্যত রক্তবহ স্রোতের (কোন কোন বিসপ রসবহ স্রোতেও পরিসপিত হয়। রোগ, পরে মাংসকে দূষিত করে। আর একটা কথা ক্যান্সার ও বিসর্প রোগের অন্তর্গত, সেটিকে আয়ুর্বেদের পরিভাষায় বলা হয় কর্দমক বিসর্প। এতে ত্বক ও মাংস আগে দূষিত হয়। বিসর্প আসছে বা এসে গেছে, তা যে প্রকারের বা যে ধরনেরই হোক না কেন, সেক্ষেত্রে সকালে ও বিকালে দু’বেলা মঞ্জিঠার ক্বাথ (১নং যোগ দ্রঃ) খেতে হবে; মঞ্জিঠা ভিজানো জল (২নং যোগ দ্র:) সারাদিনে ৪।৫ বারে পান করতে হবে। এছাড়া মঞ্জিষ্ঠার ক্বাথে (মঞ্জিষ্ঠা ২৫ গ্রাম ৩। ৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর থেতো করে ২ কিলো জলে সিদ্ধ করে ১ কিলো থাকতে নামিয়ে ঈষদুষ্ণ অবস্থায় সেই জলে স্নান করা বিশেষ প্রয়োজন।
৫. মাথা ধরায়: পিত্ত-শ্লেষ্ম প্রকৃতির লোকের কখনো কখনো শ্লেষ্মা বসে গেলে মাথা ধরে, কোন কোন ক্ষেত্রে নাক দিয়ে রক্ত পড়ে; সেক্ষেত্রে মঞ্জিষ্ঠার ক্বাথ (১নং যোগ দ্রঃ) সকালে ও বৈকালে খেলে মাথাধরা ছাড়বে, রক্ত পড়লে সেটাও বন্ধ হবে। (পূর্বে এই যোগটি নাসাপানের দ্বারা ব্যবহার করা হত।)
৬. রক্তমূত্রতায়: রক্তমূত্র বন্ধ হলে যন্ত্রণামেহ রোগেও এরকম দেখা যায়, তখন প্রস্রাব হবে লাল, মাঝে মাঝে থেমে যায়, বেশী জল খেলে সাদাটে মূত্র, জলখাওয়া স্বাভাবিক করলে পা-টা ফুলে যায়, মাথা ঘুরে; সেক্ষেত্রে মঞ্জিষ্ঠার ক্বাথ (১নং যোগ দ্রঃ) দু’বেলা খেতে হবে।
বাহ্য প্রয়োগ:
৭. নৈমিত্তিক শোথে: পোকা-মাকড় কামড়ানো, আঘাত লাগা প্রভৃতি কারণে যে শোথ দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে মঞ্জিঠা বেটে অল্প গরম করে প্রলেপ দিলে শোথ বিলীন হয়।
৮. মেছতাতে: ২। ৩ গ্রাম মঞ্জিষ্ঠা থেতো করে ২ কাপ জলে সিদ্ধ করার পর ৪ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে ঐ ক্বাথ দিয়ে দিনে ২। ৩ বার ব্যাধিত স্থানটি মুছতে হবে।
৯. চোখ ওঠায় (অভিষ্যঙ্গে): পিত্ত-শ্লেষ্ম জনিত কারণে চোখ ওঠায় চোখ লাল হওয়া, কর কর করা, ফলে যাওয়া, চোখ দিয়ে রস পড়া, মাথাধরা প্রভৃতি এইসব লক্ষণ প্রকাশ পায়। সেক্ষেত্রে ২। ৩ গ্রাম মঞ্জিষ্ঠা গরম জলে ধুয়ে থেতো করে আধ কাপ গরম জলেই ভিজাতে হবে। ৭। ৮ ঘণ্টা পরে এটিকে ভালভাবে ২। ৩ বার ছে’কে ঐ জল দিয়ে প্রত্যহ ২। ৩ বার চোখ ধুলে ২। ৩ দিনের মধ্যেই কমে যাবে। (তবে প্রত্যহ জলটা তৈরী করে নিতে হবে।)
১০. পূজকর্ণে: ২। ৩ গ্রাম মঞ্জিষ্ঠা একটু থেতো ক’রে ৩। ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সকালে ২। ১ ফোঁটা ও বৈকালে ২।১ ফোঁটা মাত্রায় কানে দিলে পুঁজ পড়াটার উপশম হয়।
১১. যোনিক্ষতে: নানা কারণে যোনিক্ষত হয়ে থাকে। এই ক্ষত যদি খুব পুরাতন ও দুর্গন্ধযুক্ত না হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে মঞ্জিষ্টার ক্বাথ (৫ গ্রাম মঞ্জিষ্ঠা ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে সেই কাথ) দিয়ে যোনি ধৌত (vaginal douche দ্বারা) করলে অল্প দিনের মধ্যেই সেরে যায়।
CHEMICAL COMPOSITION
Rubia cardifolia
Purpurin (Trihydroxy-anthraquinone); Munjistin (Xanthopurpurin2-carboxylic acid); Xanthopurpurin or purpuroxantain; and Pseudopurpurin (Purpurin 3-carboxylic acid).
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ৮৫-৮৮।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Vinayaraj
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।