বাংলা ভাষার অভিধানে কুঁচ নামের অর্থ দেয়া হয়েছে গুঞ্জাফল বা রতিফল। অথচ কুঁচের সংস্কৃত নামই গুঞ্জা। রতি মাপার জন্য এর বীজ ব্যবহার করা হয় বলে ‘রতিফল’ নামকরণের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। কুঁচ একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধি উদ্ভিদ হলেও এটি অযত্নেই রাস্তার ধার, পতিত জমি, জঙ্গলের কিনারায় জন্মাতে দেখা যেত। বর্তমানে অবশ্য এর দেখা পাওয়া দুষ্কর। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Abrus precatorius Linn. গোত্র লেগুমাইনোসী। এর শিকড়, পাতা ও বীজ ওষুধে ব্যবহার করা হয়।
অন্যান্য নাম: অনেকের নিকট কুঁচ হিসাবে পরিচিত হলেও এর আরও কয়েকটি নাম আছে- চূড়ামণি, সৌম্যা, শিখী, কৃষ্ণলা, অরুণ, তাম্রিকা, শাঙ্গুষ্ঠা, শীতপাকী, উচ্চটা, কৃষ্ণচুড়িকা, রক্তা, রক্তিকা, কাম্ভোজী, ভিল্লিভূষণা, বন্যাসা, মানচূড়া। এ ছাড়া শ্বেতগুঞ্জা বা শ্বেতকুচের কয়েকটি স্বতন্ত্র নাম আছে- ভিরিন্টিকা, কাকাদনী, কাকপীল, বক্তশল্যা। অন্যান্য ভাষায় এর হলো নাম- হিন্দিতে রত্তী, ঘুঘচী; গুজারাটে চনৌঠী; তামিল- গুন্দুমানি, ফারসি- চশমে, খমোশ; ইংরেজিতে- Indian liquorice root বা Crab’s eye.
কুঁচ উদ্ভিদের বিবরণ:
কুঁচ পাক খেলানো আরোমশ, আরোহী। কচি শাখা সবুজ, পাতা ৫ থেকে ১৭, জোয়াল ধরনের ডাঁটার দুধারে জোড়া জোড়া পত্রক বিপরীত দিকে সজ্জিত। পত্রক-ডিম্বাকৃতি বিডিম্বাকৃতি বা আয়তাকৃতি। ফুল ঘনবিন্যস্ত, হালকা কালচে-লাল থেকে হলুদাভ। ফল শুটির মতো চারকোণা, বীজ ডিম্বাকৃতি। জাতভেদে বীজের রঙ ভিন্ন রকমের হয়, যেমন- লাল রঙের বীজ কিন্তু মাথার দিকে (hilum) গোল কালো চিহ্ন (চোখ) কালো অথবা বীজ কালো, মাথার দিকে গোল সাদা চিহ্ন বা সাদা বীজ মাথায় কালো গোল চিহ্ন। চকচকে মসৃণ এবং সকল বীজ একই আয়তন ও ওজনবিশিষ্ট। আষাঢ়-ভাদ্র মাসে এ গাছে ফুল ধরে এবং অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ মাসে বীজ সংগ্রহ করা হয়।[১]
বিস্তৃতি:
গ্রামের ঝোপ এবং বনে জন্মে এই গুল্ম। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে জন্মে। বাংলাদেশের সমগ্র জেলায় বিস্তৃত। এ গাছ কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মায়ানমারসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেও পাওয়া যায়।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:
বীজে রয়েছে দুইটি লেকটিন, অ্যাবরিন-এ এবং অ্যাবরিন-বি, এবং সে রাইবোসোমের কার্যকারীতা দমনকারী প্রোটিন। বীজ গর্ভপাত, বমনোদ্রেককারী ঔষধ, রেচক ঔষধ, অণুজীবরোধী, ক্যান্সাররোধী, বলবর্ধক এবং কামোদ্দীপক। মূল বমনোদ্রেককারী ঔষধ এবং ব্যাকটিরিয়া রোধক। বীজের ক্বাথ কোন অঙ্গের বোধশক্তি লোপসহ অন্যান্য চর্মরোগে ব্যবহৃত। পাতা খিটখিটে মেজাজ, শ্বেতীরোগ, খোস পাচড়া এবং অন্যান্য চর্মরোগে ব্যবহৃত। মূল বমনোদ্রেককারী এবং রজঃস্রাব নির্গমন এবং মারাত্বক। কাশিতে যষ্ঠিমধুর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় (Ghani, 2003)।
জাতিতাত্বিক ব্যবহার:
তাজা পাতার রস সরিষার তেলের সাথে মিশ্রিত করে ব্যাথা দূরীকরনে বহির্ভাগে প্রয়োগ করা। হয়। মূল সাপের কাপড়, গ্রীবার ক্ষত এবং গিটে-বাতে ব্যবহৃত। বীজ চূর্ণ মারাত্বক মাথাব্যাথায় শোকা হয়। বীজ গবাদি পশু মারতে বিষরূপে ব্যবহৃত। গর্ভপাত ঘটাতে বীজ নরম পাতলা নেকড়া দ্বারা প্রলেপ দেওয়া হয় (Kirtikar et al., 1935)।
অন্যান্য তথ্য:
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৮ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) কুঁচ প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে কুঁচ সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই।[২]
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ৩১-৩৩।
২. এ টি এম নাদেরুজ্জামান (আগস্ট ২০১০)। "অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস" আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ ৮ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ১-২। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Len Worthington
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
গাছটির সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগলো। আগে এর গুনাগুণ জানতাম না।