ভূমিকা: তেলাকুচা হচ্ছে কিউকারবিটাসি (শসা লাউ) পরিবারের সিট্রালাস গণের একটি বহুবর্ষজীবী আরোহী বীরুৎ। এদের কাণ্ড নরম ও দূর্বল, আকর্ষীযুক্ত কোনাকার। পাতা সরল, একান্তর, করতলাকার, বহুশিরাযুক্ত। পাতার বিপরীত দিকে থাকে আকর্ষী। পাতার আকার পাঁচকোনা, ব্যাস ৫ ইঞ্চি এবং তার কিনারা বা ধার করাতের ছোট দাঁতের মত কাটা; পাতার বোঁটা আন্দাজ এক ইঞ্চি। তেলাকুচার ফুলের বোঁটা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা, আর যেসব ফুলে ফল হয় তার বোঁটা আধা ইঞ্চির মত লম্বা হয়। ফলগুলি লম্বায় দেড় বা দুই ইঞ্চির বেশি হতে দেখা যায় না। ফলগুলি আমড়া ঝাঁটি পটলের মত দেখতে হলেও আকারটা যেন পটলের মত। কিন্তু ফলের উপরটা মসৃণ বা তেলতেলা, কাঁচায় সবজি রং, গায়ে সাদা ডোরা দাগ, পাকলে লাল হয়। ফল লম্বায় দেড় থেকে ২ ইঞ্চি। উপরটা মসৃণ ও কাঁচা সবুজ রঙ। গায়ে সাদা ডোরা দাগ। পাকলে লাল। স্বাদে তিতা। কাঁচা বা পাকা কোনো অবস্থাতেই খাওয়া যায় না, কারণ ফলের শাঁস তিতো (তিক্ত) এবং বমির উদ্রেক হয়; এর মধ্যে বহন বীজ আছে, অনেক পাখির এটা প্রিয় খাদ্য, কিন্তু বাংলাদেশ ভারতে অনেকে এর ডাঁটা-পাতার ঝোল ক’রে খেয়ে থাকেন।[১]
গাছের বিবরণ: তেলাকুচার কান্ড সরু সামান্য কাষ্ঠল, বহু শাখা যুক্ত, কোণাকার, রোমশ বিহীন। আকর্ষ রৈখিক রোমশ বিহীন সরল। পত্র অখন্ড থেকে করতলাকারে খন্ডিত, ৫-১০ সেমি লম্বা, নিচের পৃষ্ঠ চকচকে গ্রন্থিযুক্ত, সামান্য দপ্তর বৃন্ত সরু, ২-৫ সেমি লম্বা। উদ্ভিদ ভিন্নবাসী।
পুংপুষ্প: মঞ্জরী দন্ড অর্ধ-সূত্রাকার, খাঁজযুক্ত, ২ ৬ সেমি লম্বা, বৃতিনল প্রশস্ত ঘন্টাকার, ৪-৫ মিমি লম্বা, খন্ড রৈখিক-ভল্লাকার, ৩ মিমি লম্বা, দলমন্ডল সাদা বা সামান্য হলুদ, ২.৫-৩.৫ সেমি লম্বা, খন্ড ডিম্বাকার, বহির্ভাগ রোমশ বিহীন, অভ্যন্তর রোমশ, পুংকেশর ৩টি, পুংদন্ড ২-৩ মিমি লম্বা, পরাগধানী অর্ধ গোলাকার, ৬-৭ মিমি লম্বা, পুংদন্ড ও পরাগধানী যুক্ত।
স্ত্রী পুষ্প: মঞ্জরীদন্ড সরু, ১-৩ সেমি লম্বা, বন্ধ্যা পুংকেশর ৩টি, তুরপুণাকার, গোড়ার অংশ অতিরোমশ, গর্ভাশয় মূলাকার, ১২-১৫ মিমি লম্বা, ৩-৪ মিমি পুরু, গর্ভদন্ড সরু, রোমশ বিহীন, ৬-৭ মিমি লম্বা, গর্ভমুন্ড ৩টি, ঘন পিড়কা যুক্ত, ৫-মিমি লম্বা। ফল অর্ধ। গোলাকার, উভয় প্রান্ত গোলাকার, ৫.০ x ২.৫ সেমি, রসালো অংশ লাল। বীজ ৬-৭ x ২.৫-৪.০ মিমি, হলুদাভ, দীর্ঘায়ত, শীর্ষ গোলাকার, গোড়ার অংশ ২টি গভীর দাগ যুক্ত। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাসে।
ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ২৪ (ChakraVorti, 1948).
আবাসস্থল ও চাষাবাদ: প্রকৃতিগতভাবে জন্মে। বাগানের বেড়ায়, তৃণভূমি, পথিপার্শ্ব, ঝোপ ও বনভূমি অথবা কোনো গাছকে আশ্রয় করে জন্মে থাকে। বীজ ও শাখা কলমে বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। প্রায় বারোমাসই এই লতাগাছে ফল হয়, তবে শীতকালে বিশেষ হতে দেখা যায় না, আর সব ফুলেই ফল হয় না।
বিস্তৃতি: আফ্রিকা, চীন, ভারত, জাপান, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান। আদিনিবাস মধ্যআফ্রিকা। বাংলাদেশের সর্বত্র জন্মে।
তেলাকুচার অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:
কচি কান্ড সবজিরূপে খাওয়া হয়। ফল ফার্মেন্টেশন ও ডিহাইড্রেশনের মাধ্যমে ফালি অবস্থায় অনেকদিন সংরক্ষণ করা হয়। মূল, কান্ড, পাতা বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত করে চর্মরোগ, শ্বাসনালীর প্রদাহ, বহুমূত্র রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। জাতিতাত্বিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, ভারতের ছোট নাগপুরের মুন্ডা আদিবাসী সম্প্রদায় কানের ব্যথায় এই গাছের রস সরষে তেলের সাথে মিশ্রিত করে ব্যবহার করে থাকে। থাইল্যান্ডে কচিফল সুপ তৈরি করে খাওয়া হয়। এই লতা গাছটির ঔষধার্থে ব্যবহার হয় ফল, পাতা, লতা ও মূলের রস। তেলাকুচার বিস্তারিত ভেষজ ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পড়ুন:
তেলাকুচা লতার ঔষধি গুণাগুণ
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৭ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) তরমুজ প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে তরমুজ সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে শীঘ্র সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন নেই।
কুদরি: ঠিক একই রকম দেখতে কিন্তু স্বাদে তিতো নয়, আর একটা ফল বাজারে তরকারি হিসেবে বিক্রি হয়, তাকে বলে কুদরি বা কুন্দরকি; তাকে অনেকে মিষ্টি তেলাকুচা বলে থাকে।
তথ্যসূত্র:
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা ২৬-৩১।
২. এম অলিউর রহমান, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩০৬। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Forest and Kim Starr
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।