নোয়ালতা (বৈজ্ঞানিক নাম: Derris scandens) হচ্ছে বাংলাদেশের মহাবিপন্ন প্রজাতির ফাবাসি পরিবারের একটি সপুষ্পক ভেষজ লতা জাতীয় উদ্ভিদ। এটি পেশি এবং হাড়ের ব্যথার চিকিত্সার জন্য থাইল্যান্ডে ঐতিহ্যগত ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই গাছের মৌখিক ব্যবহারের সবচেয়ে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে পেট এবং অন্ত্রের লক্ষণ। আরো পড়ুন
বিবরণ: নোয়ালতা ফেবাসি পরিবারের ডেরিস গণের একটি বৃহৎ, কাষ্ঠল লতা। এদের কাণ্ড মসৃণ, বাকল রক্তবেগুনি, কচি অংশ লােমশ। পত্র ৭.৫-১৫.০ সেমি লম্বা, পত্রাক্ষ গভীর খাঁজযুক্ত, মসৃণ, পত্রক বিপরীত, ৫-১৯, উপবৃত্তাকার দীর্ঘায়িত, বিডিম্বাকার অথবা বিডিম্বাকার-দীর্ঘায়িত, প্রায় সূক্ষ্মাগ্র অথবা খুব সামান্য দীর্ঘাগ্র, প্রায়শই সামান্য খাতা, উপরের পৃষ্ঠ মসৃণ এবং চকচকে, নিচের পৃষ্ঠ প্রায় লােমশ, জালিকাকার শিরাযুক্ত, গােড়া গােলাকার অথবা অর্ধসূক্ষ্মাগ্র, দৃঢ়ভাবে অর্ধচর্মবৎ, নিচের জোড়া ক্ষুদ্রতম, উপপত্র ছােট, শীঘ্রমােচী।
পুষ্প খাটো মঞ্জরীদন্ডে অসংখ্য, অক্ষীয় রেসিম, লােমশ পত্রাক্ষের পর্ব হতে গুচ্ছাকারে সজ্জিত, পুষ্পবৃন্তিকা সূত্রাকার, মঞ্জরীপত্রিকা ২, বৃতির নিচে সজ্জিত, বর্তুলাকার, সিলিয়াযুক্ত। বৃতি পাতলাভাবে সবুজ রেশমের ন্যায়, দন্তক অস্পষ্ট। দলমণ্ডল সাদা হতে গােলাপী, প্রায় ০.৮ সেমি লম্বা, আদর্শ বাদামি, দলবৃন্ত লম্বা, সরু, গােড়ায় পক্ষ সিলিয়াযুক্ত। পুংকেশর একগুচ্ছীয়। গর্ভাশয় লােমশ। ফল একটি পড, উভয় প্রান্ত ক্রমশ সরু, তীক্ষ্ম, খাড়া, উপরের সন্ধিরেখা পক্ষযুক্ত, সূক্ষ্মভাবে চাপা লােমশ। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসে।
ক্রোমােসােম সংখ্যা: ২n = ২০, ২৬ (Fedorov, 1969) ।
আবাসস্থল: পাহাড়ী বন, ম্যানগ্রোভ বন, কাটা খালের কিনারা এবং পতিত জমি।
বিস্তৃতি: ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মালয়শিয়া, শ্রীলংকা এবং চীন। বাংলাদেশে ইহা চট্টগ্রাম এবং সুন্দরবনে পাওয়া যায় । লতাটি বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুণ্ডু উপজেলার সোনাতনপুর গ্রামে টিকে আছে।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব এবং ক্ষতিকর দিক: বাকল আঁশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মূল মাছ-বিষাক্তকরণে ব্যবহৃত হয়। জাতিতাত্বিক ব্যবহার হিসেবে উল্লেখ আছে যে এদের বাকলের কৃাথ আভ্যন্তরীণভাবে সাপের কামড়ে ব্যবহৃত হয় (Bhattacharya, 1996)। বংশ বিস্তার হয় বীজ দ্বারা।
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৮ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) নোয়ালতা প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, প্রজাতিটির সংকটের কারণ ও অরণ্য উচ্ছেদ এবং বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থায় এই প্রজাতিটিকে সংরক্ষণ নির্ভর (cd) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে নোয়ালতা সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে আবাসস্থল সংরক্ষণ করতে হবে।[১]
হরিনাকুণ্ডু উপজেলার সোনাতনপুর গ্রামের পরিবেশ বান্ধব বিপন্ন প্রজাতির এই লতা গাছটি সম্পর্কে লোকজনের আগ্রহ অনবরত বাড়ছে। গ্রামবাসির মতে লতা গাছটির বয়স হবে আনুমানিক তিনশ বছর। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডাকবাংলা থেকে সোনাতনপুর বাজার পর্যন্ত গ্রামীণ মেঠো রাস্তার পাশে নবগঙ্গা নদীর ধারে একটি বিরাট বটবৃক্ষ জুড়ে এই লতা গাছের অবস্থান। সর্পিল ভাবে ওঠা লতাটি যেন আষ্টেপিষ্টে বট গাছটিকে পরম মমতায় আকড়ে ধরে আছে। বিস্ময়কর লতা গাছটির প্রস্থ আট ফুট এবং লম্বা কয়েক’শ ফুট। প্রকান্ড ও মহিরুহ হয়ে লতা গাছটি একটি বৃহৎ বটগাছ জুড়ে বিরাজমান।[২]
নোয়ালতার গাছটি এখন দর্শনীয় স্থান হিসেবে এলাকবাসির কাছে সুপরিচিত। লতা গাছের গবেষক ঢাকা সরকারি বাংলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও বিপন্ন উদ্ভিদ প্রাণী সংরক্ষণ ফাউন্ডেশনের মহাসচিব আখতারুজ্জামান চৌধুরী প্রথমে গাছটিকে সনাক্ত করেন। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Derris scandens। গাছটি লিগুমিনোসি পরিবার ভুক্ত। অধ্যাপক আখতারুজ্জামান চৌধূরী জানান, ১৯৮১ সালে ভার্সিটিতে পড়ার সময় তিনি বন্ধুদের কাছ থেকে এই লতা গাছের সন্ধান পান। তিনি আরো জানান, ২০১১ সালে তিনি লতাগাছটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এরপর জাতীয় পর্যায়ে উদ্ভিদ গবেষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি গাছটি নোয়া লতা বলে পরিচয় নিশ্চিত করেন।
উদ্ভিদ গবেষক আখতারুজ্জামান চৌধুরী জানান, এদেশীয় লতানো উদ্ভিদ হিসেবে বাংলাদেশের কোথাও পুরাতন ও এতো বিশাল লতা গাছ আর নেই। সোনাতনপুর গ্রামের বংশি বদন ঘোষ তার পূর্বসুরীদের মতো তিনিও লতাগাছটি সংরক্ষন করে আসছেন বলে তিনি জানান। গবেষনায় তিনি উল্লেখ করেছেন ‘নোয়া’ লতাগাছটি বৃহৎ কাষ্ঠল আরোহী ও চির সবুজ। লতা গাছের পাতা যৌগিক ও জুলাই মাসে ক্ষুদ্রাকৃতির সাদাটে ফুল আসে। বীজ ও কাণ্ড দ্বারা পরিবেশ বান্ধব নোয়া লতার বংশ বিস্তার ঘটে। বালাদেশ ছাড়াও ভারত, মায়ানমার ও দক্ষিনপূর্ব এশিয়ায় নোয়ালতা গাছ পাওয়া যায়। সাধারণত নদি, খাল ও পতিত জমিতে নোয়া লতা গাছ হয়।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ২০১৩ সালে লতা গাছের গবেষক অধ্যাপক আখতারুজ্জামান চৌধূরী নোয়া লতা গাছটির পরিচয় নিশ্চিত করে সোনাতনপুর গ্রামে ফলক উন্মোচন করেন। হরিণাকুন্ডুর দৌলতপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক জানান, তিনি তার পিতা ও দাদার কাছ থেকে এই লতা গাছ সম্পর্কে শুনেছেন। লতা গাছটি তিনশ বছরের বেশি বয়স হবে।
সোনাতনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ন কবির জানান, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রাপ্ত থেকে লতাগাছটি দেখতে আসেন। তিনি আরো জানান এতো দিন নাম পরিচয়হীন ছিল। এখন গাছটির নাম পাওয়ায় গ্রামবাসি খুশি। বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহের সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি নিজে এই জেলায় সাত বছরের বেশি চাকরী করেছেন। কিন্তু জানতেন না এখানে বিস্ময়কর একটি লতাগাছের ইতিহাস আছে। পাঁচ বছর আছে বিস্ময়কর লতা গাছটির সন্ধান পেয়ে
ঝিনাইদহের কয়েক জন সাংবাদিক ঘটনাস্থলে যান এবং বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করেন। এরপর লতাগাছটি নিয়ে হরিনাকুণ্ডুর সোনাতনপুর গ্রামে উৎসুক জনতার ভীড় বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে এলাকাবাসির কাছে অচেনা গাছটির গুরুত্ব বেড়ে যায়।
তথ্যসূত্র:
১. এ টি এম নাদেরুজ্জামান (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৮ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৭০। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
২. ঝিনাইদহ প্রতিনিধি, ২০ জুলাই, ২০১৭, “ঝিনাইদহে তিনশ বছরের বিপন্ন প্রজাতির লতা গাছ” বাংলাপ্রেস ডট কম, ঢাকা, http://banglapress.com.bd/news/special-news/37371.
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।