গুণঃ- কাণ্ড স্বাদে তিক্ত, উষ্ণ, মৃদুবিরেচক, ক্ষুধাবর্ধক, বলকারক, বেদনানাশক, ক্রিমিঘ্ন, কফ-বাত প্রশমক ও অস্থিসন্ধানকর। ঔষধার্থে প্রয়োগ হয় পাতা ক্ষুধাবর্ধক। কচি কাণ্ডের রস অজীর্ণরোগে, স্কার্ভিরোগে, অনিয়মিত ঋতুস্রাবে, কর্ণ ও নাসারোগে হিতকর। এই কচি কাণ্ড বলকারক, তাই অনেকে এটি রান্না করে খেয়ে থাকেন। হাঁপানীরোগেও এর কাণ্ড বেটে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এতদ্ব্যতীত এর বাহ্য প্রয়োগও দেখা যায়—যেমন অস্থিভগ্ন্যে ও দুষিত ক্ষতে বেদনা উপশমের জন্য অস্থিসংহারের কচিকাণ্ড বেটে প্রলেপের ব্যবস্থা। মূলের গুড়ো অস্থিভগে হিতকর। ব্যবহার্য অংশ- পাতা ও মাংসল ডাঁটা।[১]
হাড়জোড়া লতা-র পরিচিতি:
হাড়জোড়া (বৈজ্ঞানিক নাম: Cissus quadrangularis) লতানো শ্রেণীর উদ্ভিদ।এ গাছ লতিয়ে লতিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যায়। অনেক সময় গাছকে পত্রহীন দেখায়। পাতা এক থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। দেখতে ঠিক হৃদপিণ্ডের মতো। তিন থেকে পাঁচটি অংশে বিভক্ত। পাতার কিনারাগুলো করাতের মতো কাটা। পুষ্পগুচ্ছ ছোট বোঁটাতে থাকে। খুব চকচকে এবং লোমযুক্ত। হাড়জোড়া ফল দেখতে অনেকটা মটরের দানার মতো লাল রং-এর হয়। ফুলের পাপড়ি ডিম্বাকৃতি, আগার দিকটা সরু এবং রং সাদা। লতার ডাটা একটি গাঁটের সাথে মাটিতে ফেলে দিলে তার থেকেই নতুন চারাগাছ জন্মায়।[২]
অন্যান্য নাম:
সংস্কৃত নাম অস্থিসংহার। বাংলা নাম হাড়জোড়া, হাড়ভাঙ্গা, হিন্দীতে। হাড়জোড় নামে পরিচিত। বোটানিক্যাল নাম Cissus quadrangula, Linn. ও ফ্যামিলি Vitaceae.
হাড়জোড়া লতা-র ভেষজ গুণাগুণ
১. ঋতুর অনিয়মে: হাড়জোড়া লতা-র কাণ্ডের রস ২০ মিলিলিটার, গাওয়া ঘি সমপরিমাণ, গোপীচন্দন ১০ গ্রাম ও পাঁচ গ্রাম চিনি, সমস্ত জিনিস একসাথে মিশিয়ে সকালে ও সন্ধ্যায় প্রতিদিন খেলে ঋতু নিয়মিত হয়।
২. কানে পুঁজ হলে: শিশু, কিশোর এবং বড়দের কানে পুঁজ হলে হাড়জোড়া গাছের কাণ্ডের রস একটি মূল্যবান ওষুধ। বহু যুগ আগে থেকে এর প্রচলন রয়েছে। কাণ্ডকে ভালোভাবে বেটে তার রসটা পরিষ্কার পাতলা কাপড়ে ছেঁকে নিতে হবে। দিনের মধ্যে দু’বার তিন ফোঁটা করে প্রয়োগ করতে হবে। মাত্র তিন থেকে চার দিন ব্যবহার করা দরকার। তবে প্রতিদিন টাটকা কাণ্ড সংগ্রহ করে তার রস দিতে হবে।
৩. হাড়ের যন্ত্রণায়: হাড়জোড়া গাছের কাণ্ড (অবশ্যই ওপরের শক্ত খোসা আগে ছাড়িয়ে নিতে হবে) ৬৫ গ্রাম এবং খোসা ছাড়ানো কলাইয়ের ডাল ৩০ গ্রাম, এক সাথে বেটে মটরের দানার মতো বড়ি তৈরি করে নিতে হবে। কাজটি শেষ হলে এক ঘণ্টা বাদে। সমস্ত বড়ি তিলের তেলে ভেজে রোজ সকালে দু’টি বড়ি একসাথে মোট সাত দিন খাওয়া দরকার।
৪. পুষ্টির অভাবজনিত রোগে: হাড়জোড়া গাছের কাণ্ডের রস ২০ মিলিলিটার এক কাপ ঠাণ্ডা পানির সাথে মিশিয়ে দিনের বেলায় সকালের দিকে খেলে শরীরে পুষ্টির অভাব পূরণ হয়। তবে নিয়মিত এবং একমাস খাওয়া দরকার।
৫. শ্বাসরোগে: হাড়জোড়ার ডাঁটাগুলি কুচি কুচি ক’রে কেটে শুকিয়ে চূর্ণ করে ছে’কে নিতে হবে। ওই চূর্ণ একটি নস্যের পরিমাণ (৫০ মিলিগ্রাম আন্দাজ) নিয়ে জলসহ সকালে ও সন্ধ্যার পর দু’বার খেতে হবে। প্রথমে একবার করে খেয়ে লক্ষ্য করতে হবে যে কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা; তবে জলটি ঠাণ্ডা খাওয়া উচিত নয়। ঈষদুষ্ণ হওয়াই ভালো। এটাতে অনেকের এলার্জি হ’তে দেখা যায়, সুতরাং খুব সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত।
৬. হাড় ভেঙ্গে গেলে: মানুষের তো বটেই, পশুপক্ষীরও হাড় ভেঙ্গে যায়, সেক্ষেত্রে নিম্নে কয়েকটি ভেষজ একসঙ্গে বেটে, একটু গরম করে প্রলেপ দিয়ে দেখুন, নিশ্চয়ই ফল পাবেন। গাঁদাল পাতা ২ ভাগ (Paederia foetida), নিসিন্দার পাতা ২ ভাগ (Vitex negundo), ধুতরার পাতা ১ ভাগ (Datura metel) এবং হাড়জোড়ার ডাঁটা ২ ভাগ, একসঙ্গে বেটে গরম করে ওখানে লাগালে ব্যথা ও ফুলা সবই চলে যাবে, তবে ১ দিন অন্তর লাগাতে হবে। ভগ্নস্থান বেশী লাল হ’লে ২ দিন অন্তর লাগাতে হবে আর যেদিন লাগালো হবে না, সেদিন যেকোন তেল (তৈল) একটু লাগিয়ে দিতে হবে। অস্থিভগ্নে (দ্বিতীয় যোগ) উপরিউক্ত ক্ষেত্রে হাড়জোড়া ১ ভাগ, রসুন সমপরিমাণ এবং গুলগুলু, একভাগ একসঙ্গে বেটে, একটু গরম করে প্রলেপ দিলে (সম্ভব হলে বেধে রাখন) ওটা জড়ে যাবে, তবে ১ দিন বা ২ দিন তান্তর লাগাতে হবে।
এছাড়াও ভাঙ্গা জায়গায় হাড়জোড়া লতা-র শুকনো কাণ্ডের গুড়া সামান্য ঠাণ্ডা পানির সাথে মেখে বেশ মোটা করে প্রলেপ দিয়ে কাপড়ের ফালি দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। দুই-তিন দিন অন্তর প্রলেপ ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে একই পদ্ধতিতে প্রলেপ দেয়া দরকার। আর বাঁধতে হবে একটু চাপ দিয়ে। অবশ্য তার আগে সঠিক জায়গায় বসিয়ে দেয়া দরকার। তিনবার প্রলেপ পাল্টে দেয়ার পর চতুর্থবারে আরও শুরু করে প্রলেপ দিয়ে চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ বাধা থাকবে। এর সাথে হাড়জোড়া গাছের কাণ্ডের গুড়া রোজ ২ চামচ করে একবার ঠাণ্ডা পানির সাথে খেতে হবে।
৭. অগ্মিমান্দ্যে: যাঁদের পেটে বায়ু এবং দাস্ত পরিষ্কার হয় না, অতএব এটি বায়ু প্রধান অগ্নিমান্দ্য। হাড়জোড়ার ডাঁটার খোসা ছাড়িয়ে (এটাতে ওল কচুর রসের মত হাত চুলকোয়) সমান পরিমাণ ওজনে মাষকলাই মিশিয়ে একসঙ্গে বাটতে হবে (লঙ্কা বাটার মত সাবধানেই বাটতে হবে, তারপর তাকে একটু শুকিয়ে মটর পরিমাণে বড়ি করতে হবে; তারপর তাকে আরও একটু শুকিয়ে নিয়ে তিল তেলে (তৈলে) ভেজে নিতে হবে। এমনভাবে ভাজতে হবে যেন কাঁচাও না থাকে আবার পড়েও না যায় (মোটকথা, ভিতরে যেন কাঁচা না থাকে), তারপর তাকে শিশিতে রেখে দিন। যে কোন প্রকারের পেটের বায়ুতে ওই বড়ি একটি করে দু’বেলা ঠাণ্ডা জলসহ খেলে এটাতে বিশেষ উপকার হয়। তবে যাঁদের বেশী এলার্জি আছে তাঁরা অসুবিধে বোধ ক’রলে এটা খাবেন না।
৮. অম্লপিত্ত রোগে: এ রোগে যিনি আক্রান্ত হন, তার পরিণতিতে আসে গ্যাসট্রিক আলসার, ডিয়োডিনাম, আলসার প্রভৃতি অক্ষত রোগ। এক্ষেত্রে হাড়জোড়ার কচি পাতা ও ডাঁটা কুচিয়ে শুকিয়ে গুঁড়া করে নিতে হবে; সেই মিহি চূর্ণ দু’টিপ নস্যির মত এবেলা ওবেলা দু’বার ঠাণ্ডা জল দিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা দুই-তিন দিনের মধ্যে খুব ভাল উপকার পাওয়া যাবে। তবে যাঁদের এলার্জি আছে তারা ২/১ দিন খাওয়ার পর অস্বস্তি বোধ হ’লে আর না খাওয়াই ভাল।
৯. কৃশতায়: যেসব বালক পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে, তাদের। একটিপ নস্যির পরিমাণ চূর্ণ দুধসহ খাওয়ার ব্যবস্থা দেওয়া আছে। এটা আমরা প্রাচীন বৈদ্যগণের মুষ্টিযোগের খাতায় দেখতে পাই। এটি ওল বা কচুর মত গাল চুলকোয়, সেক্ষেত্রে বিশেষ বিচার করে এটা ব্যবহার করা উচিত, অথবা অন্য প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা উচিত। আর একটি প্রক্রিয়ায় এটা ব্যবহার করা যেতে পারে, ওই চূর্ণগুলিকে ঘিয়ে তাপ ভেজে রেখে দিতে হবে। তা থেকে একটিপ নস্যির আন্দাজে ওই ঘিয়ে ভাজা গড়ে প্রত্যহ দুধ বা জলসহ খেতে হবে। দু’বারও খাওয়া যায়।
১০. ক্রিমির উপদ্রবে: ক্রিমির উপদ্রবে অনেকের দাস্ত পরিষ্কার হয় না, কোনদিন মল কঠিন হয়ে গেলে আবার কোনদিন পাতলা দাস্ত হলো, তার সঙ্গে মলদ্বারে অস্বস্তি, চুলকানি, তাঁরা উপরিউক্ত নিয়মে ঘিয়ে ভাজা অস্থিসংহার চূর্ণ ২-৩ টিপ নস্যির পরিমাণ মত এবেলা ওবেলা দু’বার জলসহ খেতে পারেন; তাঁদের এ অসুবিধেটা চ’লে যাবে।
১১. বাত রোগে: গা-হাত-পা ব্যথা, যন্ত্রণায় কষ্ট হচ্ছে এটা প্রায়ই হয়, এক্ষেত্রে হাড়জোড়ার ফুলুরি করে খেলে বিশেষ উপকার হবে। তৈরী করার নিয়ম হলো- আঙ্গুলের এক গাঁটের মত (পর্ব) হাড়জোড়ার ডাঁটা ওপরের খোসাটাকে ছাড়িয়ে তাকে এক-দেড় মঠো আন্দাজ ২৫-৩০ গ্রাম ডালের সঙ্গে বেটে নিয়ে তাকে টিকিয়া করে ভাজতে হবে, অর্থাৎ গোল ফুলুরি না করে চ্যাপ্টা করে ভাজতে হবে। সেইটাই ভাত খাওয়ার সময় খেতে হবে। অবশ্য অন্য সময় মুড়ির সঙ্গেও খাওয়া যায়।[১][২]
CHEMICAL COMPOSITION
Cissus quadrangula Linn.
Plant contains:— Moisture 13.1%; proteins 12.8%; fat and wax 10%;
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্র:
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২১২-২১৪।
২. আঃ খালেক মোল্লা সম্পাদিত;লোকমান হেকিমের কবিরাজী চিকিৎসা; মণিহার বুক ডিপো, ঢাকা, অক্টোবর ২০০৯; পৃষ্ঠা ১৪০-১৪১।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
আমারটা পড়ে দেখুন, ভালো কাজ করে, ঘরে তৈরি করা যায়। আমার মা বানিয়ে দিয়ে গেছেন। এই লিংকে গিয়ে দেখুন: https://sites.google.com/view/compostfertilizer/home