মালতী বা মালতী লতা বনাঞ্চল পরিবেশে জন্মে কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বাড়ির বাগানেও বেচে থাকতে পারে। ফুল ও ফল ধারণ মে থেকে জানুয়ারি। মালতীর মূলের ক্বাথ জ্বর উপশমে বলবর্ধক এবং মূত্র সংক্রান্ত অসুবিধা প্রশমনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
মালতী লতার বিবরণ:
এটি লতানো ও শক্ত কাণ্ডবিশিষ্ট উদ্ভিদ। এর শাখা-প্রশাখা কোমল ও লোমযুক্ত, পাতা ডিম্বাকৃতি, রৈখিক আয়তাকৃতি, ৮-১০ সেমি লম্বা এবং ৪-৫ সেমি চওড়া, বোঁটার দিক উপবৃত্তাকৃতি, নিচের শিরাগুলো বেশ দৃঢ়, চর্মসদৃশ। পুষ্পদণ্ডের মাথায় ফুল হয়। ফুল ছড়ানো, সাদা হালকা সুগন্ধযুক্ত শক্ত, লোমাবৃত এবং গুচ্ছে থাকে, ফুলের ব্যাস ২.৫ সেমি. পুষ্পস্তবক লম্বা, গোলাকৃতি এবং সাদা রঙের হয়। স্ত্রী পুষ্পদণ্ড নত, গর্ভকেশর কোমল লোমে আবৃত। ফল আকারে ছোট, অগ্রভাগ ক্রমশ সঙ্কুচিত। বীজ ডিম্বাকৃতি, চ্যাপ্টা ১ সেমি-এর মতো লম্বা। বর্ষাকাল থেকে শরৎকাল ফুল ফোটার সময় এবং শীতের শেষে ফল পাকে।
মালতী লতার বিস্তার:
বিশ্বে Aganosma-এর আটটি প্রজাতির উল্লেখ পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা, বিহার, দাক্ষিণাত্যে এই প্রজাতিই অধিক দেখা যায়। বাংলাদেশে মূলত বাগানে আবাদি হিসাবে পাওয়া যায়।
আরো পড়ুন: মালতী লতা বাংলাদেশে জন্মানো আলংকারিক ও ভেষজ উদ্ভিদ
প্রাচীন গ্রন্থে:
সমগ্র গাছ ওষুধে ব্যবহৃত হলেও এর শিকড়ই প্রধানত ওষুধে লাগে। সুশ্রুত সংহিতার লিখেছিলেন মালতী এবং মল্লিকা ফুল এ দুটিই তিক্ত রসসম্পন্ন, তাই পিত্তবিকার দূর করে এবং সুগন্ধিযুক্ত। মালতী ফুলের রস প্রলেপ দ্বারা কুষ্ঠরোগের উপকারের কথা বলা হয়েছে।
চরকের মতে মুখের ভিতর পরিষ্কার করা, দাঁত মাজা এবং জিভ ছোলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে দাঁতমাজার জন্য কষায় কটু তিক্ত রস সম্পন্ন দাতন হওয়া দরকার এরজন্য করঞ্জ, করবী, আকন্দ, মালতী, অর্জুন, পিয়াশাল গাছের ডালের দাতন হলেই ভালো হয়। এছাড়াও মালতী ফুলের রস উৎকৃষ্ট রসায়ন।
আধুনিক শাস্ত্রে:
বৈদিক যুগের ব্যবহারের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফমুলারী ১৯৯২-তে ৪টি ওষুধে মালতী ব্যবহারের উল্লেখ করা হয়েছে। আয়ুর্বেদে মালতীকে ‘জাতীপুষ্প’ বলা হয়। বসন্তজনিত মুখ ও গলার ক্ষত প্রশমক হিসাবে ব্যবহৃত ‘জাত্যাদি ক্বাথ’ ওষুধে মালতীর পাতারও রক্তগতবাত, রক্তপিত্ত, রক্তপ্রদর, যোনিবিকার, ব্রণশোষ, ক্লৈব্য প্রশমক হিসাবে ব্যবহয়। অশ্বগন্ধার তেল-এ মালতীর ফুল-স্মৃতিশক্তিবর্ধক ও স্বপরিষ্কারক হিসাবে ব্যবহৃত। ব্রাহ্মীঘৃতে মালতীর ফুল উম্মাদ ও মানসিক রোগ প্রশমক হিসাবে ব্যবহৃত।
মালতী লতার ভেষজ ব্যবহার:
১. প্রস্রবকালে শরীরের দাহ: প্রস্রবকালে কোনো কোনো মায়ের সর্বশরীরে বিশেষ দাহ সৃষ্টি হয়। গায়ে কাপড় পর্যন্ত রাখতে পারে না। এক্ষেত্রে মালতীফুল শুকনা ৩ গ্রাম বা কাচা ফুল হলে ৬ গ্রাম বেটে সামান্য চিনি দিয়ে ১ কাপ শরবত তৈরি করে ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর পর একটু একটু করে খাওয়ালে প্রসূতির গায়ের দাহটা চলে যাবে।
২. ঋতুস্রাবকালীন ব্যথা ও সমস্যা: ঋতুকালীন কোনো কোনো মেয়ের খুব যন্ত্রণা হয়। অল্প স্রাব হয়, একদিন হয়ে বন্ধ হয়ে যায় তারপর আবার হয়। এক্ষেত্রে দুটি পন্থা অবলম্বন করা যায়- (ক) পাতাসেদ্ধ করে যে ক্বাথ হয় তা ঈষদুষ্ণ অবস্থায় থাকতে কোমর ও তলপেট মুছতে হবে। এর দ্বারা স্রাবটি ভালো হবে। (খ) মালতী গাছের শিকড়ের ছাল ৩ থেকে ৪ গ্রাম আন্দাজ বেটে পানিসহ খেলে উপকার হয়।
৩. প্রস্রাবের সমস্যায়: প্রস্রাবে জ্বালা থাকলে মালতী গাছের মূলের ছাল ৩-৪ গ্রাম এবং একটি বা দুটি পাতা একসঙ্গে বেটে শরবতের মতো খেলে ঐ জ্বালাটা চলে যায়।
৪. দাঁতের সমস্যায়: দাঁতের মাড়ি ফোলা, দাঁতের গোড়ায় পুঁজ জমলে, ছোপ পড়লে প্রতিদিন মালতী গাছের ডাটা দিয়ে দাঁতন করলে নিরাময় হয়।
৫. পায়ের কড়ায়: এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে মালতী পাতার রস ঈষৎ গরম করে কয়েকদিন লাগালে ঐ কড়া নরম হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ৭৮-৭৯।
বি.দ্র: ছবিটি নেওয়া হয়েছে উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে। আলোকচিত্রী: Dinesh Valke
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।