ভূমি-প্রসারণী লতা, লতার কাণ্ডটি তিনটি শিরাবিশিষ্ট, তবে তার কোন কোন জায়গা গোলও দেখা যায়। এটি পশ্চিম বাংলার সর্বত্র জঙ্গলের ধারে অথবা পোড়া জায়গায় অথবা নদীর ধারে জন্মে। এছাড়া ভারতের সর্বত্র, এমন-কি তিন হাজার ফুট উচু পর্যন্ত স্থানেও এটি অযত্নসম্ভূত হয়েই জন্ম নেয়। লতা কাটলে বা ভাঙ্গলে দুধের মত বর্ণ-বিশিষ্ট চটচটে আঠা বেরোয়। সাধারণতঃ পাতাগুলি ৪। ৫ ইঞ্চি লম্বা, গোড়ার দিকটা হৎপিণ্ডের মত এবং অনেকটা কলমীশাকের পাতার মতও আকৃতিবিশিষ্ট এবং ফুলগুলিও কলমীশাকের ফলের মতই। ফল ডিম্বাকৃতি গোল। বহুদিনের গাছ হলে মূলের ছাল বেশ পরে হয়। ত্রিবৃৎ কৃষ্ণ, রক্ত ও শ্বেতবর্ণ ভেদে ৩ প্রকারের, তন্মধ্যে কৃষ্ণ বিবৃৎ অধিক শক্তিশালী, তৎপরে রক্ত এবং শেষে শ্বেত ত্রিবৃৎ। মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল ও ফল হয়।
এটিকে বাংলায় তেউড়ী, তহরী, দুধকলমি, দুধিয়া কলমী; সংস্কৃতে ত্রিবৎ, হিন্দীতে পিটোহারী বলে। এর বোটানিক্যাল নাম Operculina turpethum (Linn.) Silva Manso, পরিবার: Convolvulaceae. ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ মূল ও মূলের ছাল এবং ফুল।
দুধকলমি লতার উপকারিতা:
১. মনোরোগে: কল্পিত শঙ্কায় যাঁদের মন খারাপ হয়। এটা বংশগত, প্রধানভাবে মাতৃকুল থেকেই এটা এসে যায়। অর্থাৎ অভাব, ঈর্ষা, অকল্পনীয় ঘটনাকে মনে মনে চিন্তা করে কেমন আনমনা হ’তে থাকেন, সেক্ষেত্রে দুধ কলমির চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম এবং হরীতকীচণ ১ গ্রাম একসঙ্গে গরমজলসহ রাত্রে শয়নকালে খেতে দিতে হয়। কয়েকদিন ব্যবহারে ওই মনোবিকারটা কেটে যায়। তবে যাঁদের কোষ্ঠকাঠিন্যের ধাত তাঁরা দ্বিগুণ মাত্রায় খেতে পারেন, এটাতে দাস্ত পরিষ্কারও হবে।
২. উদর রোগে: এক্ষেত্রেন কলমির মূল চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম থেকে ১ গ্রাম মাত্রায় প্রত্যহ সন্ধ্যার পর (শয়নকালে) অল্প চিনির জলসহ খেতে হবে। এর দ্বারা অপান-বায়ুর ক্রিয়া স্বাভাবিক হয়ে উদাবর্তের উপশম হবে, তবে কিছুদিন ১ দিন অন্তর ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে। কিন্তু পথ্যের বিচার না করে চললে পুনরাক্রমণ হবে।
৩. অশ্লপিত্ত রোগে: এই রোগ নিরসনের জন্য দুধকলমি চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় জলসহ রাত্রিতে শয়নকালে খেতে হবে। তবে এটাতে যদি দাস্ত পরিষ্কার না হ’তে থাকে তাহলে ১ গ্রাম মাত্রায় খেতে হবে। তবে নিত্য ব্যবহার করতে হলে ৫০০ মিলিগ্রাম ব্যবহার করাই ভাল। আর একটা বিষয় জানা থাকা ভালো, মিষ্টি খাওয়া একেবারে বন্ধ না করলে অশ্লপিত্ত রোগ সারে না।
৪. কামলা বা জন্ডিস রোগে: লতার মূল চূর্ণ প্রয়োগের ক্ষেত্র হলো, যখন সারা শরীরটা সর্বদা জ্বালা করতে থাকে, মলটা নরম, প্রস্রাব কম হ’তে থাকে, যেটুকু হয় সেটাও হলদে, সারা শরীরে যেন হলুদ মাখা হয়েছিলো এই রকম রং হয়ে গিয়েছে। এই ক্ষেত্রে উপস্থিত হ’লে কলমির মূল চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় এক/দেড় চামচ চিনি মিশিয়ে প্রত্যহ একবার (রাত্রে শয়নকালে) জলসহ খেতে হবে। ২। ৩ দিন খাওয়ার পর এসব উপসর্গ কমে যাবে।
৫. আমবাতে: এই রোগেপশমে একমাত্র প্রধান উপায় হলো, শরীরের আমরস নিষ্কাশন করা, সেকাজে কলমি মূল চূর্ণের আর কোন বিকল্প নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে মূল চূর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় রাত্রে শয়নকালে অল্প গরমজলসহ খেতে হবে। তাতেও যদি দাস্ত পরিষ্কার না হয় তাহলে সকালের দিকেও আর একবার দুই/একদিন খেতে হবে।
৬. রক্তগুল্মে: এটি স্ত্রীরোগ। অনেক সময় মাসিক স্রাব বন্ধ হয়ে যায়, তার দুই/এক মাস পর থেকে গর্ভের সমস্ত লক্ষণ প্রকাশ পায়। এরূপ ক্ষেত্রে উপস্থিত হলে চিকিৎসক বিভ্রান্ত হয়ে পড়তেন, যে এটা গর্ভ কিনা। এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হ’লে ওটাকে স্রাব করিয়ে নিষ্কাশন করার পদ্ধতি ছিল, সে কার্যে এই তিউড়ির পাতা সিদ্ধ করে ব্যবহার করাতে হতো। এই পাতা (কাঁচা) ১৫। ২০ গ্রাম নিয়ে তাকে শাকের মত রান্না করে (ভাজা নয়) প্রত্যহ বৈকালের দিকে অথবা রাত্রের দিকে খেতে দিলে ৩। ৪ দিনের মধ্যেই মাসিক স্রাব দেখা দেবে, এবং স্রাব হ’য়ে ওই সঞ্চিত রক্তটা বেরিয়ে যাবে।
৭. জলোদরে (Dropsy): পেটে জল জমেছে, ট্যাপ (tap) করে দিলেও আবার জল জমছে; সেক্ষেত্রে প্রাথমিক কর্তব্য হলো জল যা’তে আর জমতে না পারে তার জন্য ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা করা, তারপর যেটা জমে আছে সেটাকে প্রত্যহ দুধ কলমির মূল চূর্ণ প্রয়োগ করে বের করে দেওয়া। প্রত্যহ রাত্রে শয়নকালে দুই বা তিন গ্রাম মাত্রায় ঈষদুষ্ণ জলসহ খেতে হবে। যদি দেখা যায় দান্ত হচ্ছে বটে, কিন্তু মলের সঙ্গে বিশেষ জল বেরচ্ছে না, তাহলে আরও ১ গ্রাম মাত্রা বাড়ানো যেতে পারে। তবে সেটা রোগীর শরীরের বলাবল বিচার করে অর্থাৎ বেশী দুর্বল রোগীকে মাত্রা বাড়ানো চলবে না। এসব ক্ষেত্রে প্রত্যহ অল্প অল্প জল নিঃসরণ করানোর পদ্ধতি নেওয়াই ভাল।
৮. শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যে: এরা প্রায়ই কাঁদে, আড়া-মোড়া খায়, ক্ষিধে নেই, দুধও খেতে চায় না, পেটে বায়ু হয়। এক্ষেত্রে কলমির মিহিচূর্ণ ১ টিপ নস্যি পরিমাণ নিয়ে ১০।১৫ ফোঁটা মধু মিশিয়ে আধ ঘণ্টা অন্তর ২। ৩ বারে চাটিয়ে দিতে হবে, এর দ্বারা দাপ্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে, তবে প্রত্যহ এ অভ্যাস করা উচিত নয়।
৯. কোষ্ঠকাঠিন্যে: যাকে আমরা চলতি ভাষায় বলে থাকি Constipation। প্রথমতঃ প্রয়োজন যকৃতের ক্রিয়া যেটাতে ভাল হয় এমন ধরনের আহার-বিহার করা। তার সঙ্গে দুধকলমি মূলের চূর্ণ অন্ততঃ ১ গ্রাম করে রাত্রে শয়নকালে ঈষদুষ্ণ জলসহ সপ্তাহে অন্ততঃ ৩ দিন খাওয়া। এইভাবে ৩। ৪ সপ্তাহ খেলে ওই অসুবিধেটা চলে যাবে।
১০. খোস-পাঁচড়ায়: যেক্ষেত্রে যকৃতের স্বাভাবিক ক্রিয়া না হওয়াতে শরীরে পিত্তবিকারজনিত খোস-পাঁচড়া হতে থাকে সেখানে মূল চূর্ণ বিশেষ উপকার হতে দেখা যায়। প্রত্যহ মূল চূর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় রাত্রে শয়নকালে ঈষদুষ্ণ জলসহ খেতে হবে। অবশ্য কয়েকদিন খেলেই এর উপশম হবে।
CHEMICAL COMPOSITION
Operculina turpethum Linn. The root bark contains :— glycosides; turpethin and saponin
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ৯৩-৯৫।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।