পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, নেপাল, হিমালয়ের পাদদেশ, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, বাংলাদেশ ইত্যাদিতে অধিক পরিমাণে পিপুল জমে। লতানে গাছ, মাটিতে পড়ে থাকে, কখনো বা অন্য গাছে উঠে পড়ে। লতাটির সামনের অংশ কোমল, পাতাগুলি ডিম্বাকৃতি, অনেকটা পানের মতো দেখতে, ২/৩ ইঞ্চি লম্বা। একলিঙ্গী ফুল, পুষ্পদণ্ড ১-৩ ইঞ্চি লম্বা, সোজা ও উন্নত। ফলগুলি সবুজ হরিদ্রাভ বর্ণের, পাকলে রক্তবর্ণের এবং শুকিয়ে গেলে কৃষ্ণাভ ধূসর বর্ণের হয়। বর্ষাকালে ফুল হয় এবং শরৎকালে ফল হয়।
অন্যান্য নাম:
সংস্কৃত নাম পিপলী, বাংলায় পিপুল ও হিন্দীতে পীপল বলে। বোটানিক্যাল নাম Piper lomgum Linn., ফ্যামিলী Piperaceae. এর আর একটি জাত আছে, তাকে পাহাড়ী পিপল বলে, বোটানিক্যাল নাম Piper syluaticuum Roxb.. আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বেশী জন্মে, পাতাগুলি কিঞ্চিৎ বড় হয়।
প্রকারভেদ:
পরিচিতি পিপুল ৪ প্রকারের: পাহাড়ি পিপুল, বন পিপুল, গোল পিপুল, দেশি পিপুল বা পিপলা। বর্তমানে ২ প্রকারের পিপল বাজারে পাওয়া যায়, বড় ও ছোট। বড়গুলি সৈংহলী পিপুল আর ছোটগুলি পশ্চিমবঙ্গে অধিকজাত পিপুল।[১]
উপকারিতা:
পিপুল বা দেশি পিপুল বা পিপলা বা পিপলা-মূল বা পিপুল মরিচ (বৈজ্ঞানিক নাম: piper longum) হচ্ছে পিপারাসি পরিবারের পিপার গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এদের প্রধান গুণ হচ্ছে এরা শ্বাসকষ্ট উপশম করে। পিপুলের ব্যবহার রান্নায় কম হলেও নামটা অনেকেরই জানা। পিপুলকে ঔষধি হিসেবে সেবন করলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে। পিপুল দীপন বা উদ্দীপিত করে, তীক্ষ্ণ, উষ্ণ, রুক্ষ, পিত্তকারক ও মলাবেগ করায়। কফ, বায়ু, উদর রোগ, গ্যাস, লিভারের অসুখ, গুল্ম, কৃমি, শ্বাস রোগ উপশম করে। ক্ষয় রোধ করে। মস্তিষ্কের দুর্বলতা, উগ, বাত প্রকোপ, সূতিকা রোগ, ঋতুস্রাব পরিস্কার না হওয়া, নিদ্রাহীনতা কফ, শ্বাস প্রভৃতি শারিরীক অসুবিধেতে প্রাচীন কাল থেকে ঘরোয়া ওষুধ হিসেবে পিপুল ব্যবহার করা হয়ে আসছে। [২]
সুস্থ থাকতে পিপুলের ব্যবহার:
১. ম্যালেরিয়া জ্বরে: পিপুলের গুঁড়া মধু মিশিয়ে চাটলে এবং তার পরে গরম গরম গরুর দুধ খেলে বিষমজুর (ম্যালেরিয়া) সারে।
২. কাশি সারাতে: পিপুল, শুঁঠ (শুকনা আদা) আর বহেড়াদলের (কবিরাজি দোকানে পাওয়া যায়) চূর্ণ মধু মিশিয়ে চাটলে কাশি সেরে যায়। এছাড়া কাশির সঙ্গে থাকবে ঘুষঘুষে জ্বর আছে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের আশঙ্কা হয় হয়তো এটা ক্ষয়জ জ্বর, এক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের চিকিৎসা শুরু করার পূর্বে পিপুল চূর্ণ ২৫০ মিলিগ্রাম ও জলসহ সকালে ও বিকালে দু’বার করে খেতে হয়, এর দ্বারা ওই কাশি ও ঘুষঘুষে জ্বর ছেড়ে যেতে পারে। অবশ্য ৪/৫ দিন খাওয়ার পর এর উপকারিতা উপলদ্ধি হবে।
৩. বমি বন্ধ করতে: পিপুল আর শুঁঠ (শুকনা আদা) সম পরিমাণে নিয়ে চূর্ণ করে মধু মিশিয়ে চাটলে বমি বন্ধ হয়।
৪. অম্ল কমায়: পিপুলের গুঁড়াতে চিনি মিশিয়ে এক মাস ধরে নিয়মিত খেলে অম্লাদিতে উপকার হয়।
৫. অনিদ্রা কমাতে: পিপুলের গুঁড়া গুড় মিলিয়ে খেলে এবং তারপরে গরম দুধ খেলে ঘুম ভাল হয়। [১][২]
৬. জীর্ণ জ্বর সারাতে: যে জ্বরের ফলে শরীরের গঠন নষ্ট হচ্ছে অথচ অগ্নিবল ঠিক আছে, সেখানে বুঝতে হবে খাদ্যরসটি রক্ত তৈরীর যোগ্য হয়নি; তার জন্য ধীরে ধীরে রক্তের বলও কমছে, তার ফলে চামড়ায় শুষ্কতা, চোখ ফ্যাকাসে হচ্ছে, সেক্ষেত্রে। পিপুল চূর্ণ ২৫০ মিলিগ্রাম ৫/১০ ফোঁটা ঘি মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করতে হয়, এর দ্বারা কয়েকদিনের মধ্যেই জ্বরটা ছেড়ে যাবে এবং অন্যান্য সমস্যারও উপশম হবে, যার ফলে রোগীর মানসিক বলও ফিরে আসবে।
৭. মেদহ্রাস: যাঁরা মেদেস্বী, তাঁরা এটাকে কমাতে চাইলে ২৫০ মিলিগ্রাম পিপল চূর্ণ আধ চা-চামচ মধুসহ খাওয়ার ১০/১৫ মিনিট বাদে এক কাপ ঈষদুষ্ণ গরমজল খাওয়ার ব্যবস্থা করুন। তবে যাঁদের শ্লেষ্মপ্রধান ধাতু, তাঁরা সকালে ও বিকালে উপরিউক্ত মাত্রায় দু’বার খেতে পারেন। এইভাবে ১৫/২০ দিন ব্যবহার করলে মেদের হ্রাস হবে, তবে তার সঙ্গে আহারের নিয়মও পালন করতে হবে। যেমন চিনি বা যেকোন মিষ্ট দ্রব্য মোটেই না খাওয়া, আলু বর্জন করা এবং একবেলা ভাত ও একবেলা কড়া সেকা রুটি খাওয়া, তবে প্রাচীন বৈদ্যগণ বলেন, শ্যামাচালের ভাত, রুটি, (গমের মত পেষাই করে নিতে হয়) মেদহ্রাসে অদ্বিতীয়।
৮. হাঁপানিতে: অল্প শ্রমেই হাঁপানি, অল্প পেটভারি করে খেলেই হাঁপের কষ্ট, তাঁদের উচিত পিপুলচূর্ণ ২৫০ মিলিগ্রাম জলসহ আহারের কিছু পরেই খাওয়া, এর দ্বারা হজমও ভালো হবে হাঁপেরও কষ্ট হবে না। নইলে ২ গ্রাম পিপুল একটু থেতো ক’রে সেটা ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে আদাজ ২ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে সেই জলটা ২/৩ ঘণ্টা অন্তর ৩/৪ বারে খেতে হবে। এর দ্বারা হাঁপের কষ্ট আর আসবে না।
৯. অগ্নিমান্দ্য বা অজীর্ণ: এর কারণ হয়তো দাঁতের অভাব হয়েছে অথবা থেকেও নড়বড় কিম্বা ঋতুর বিপর্যয়—এর ফলে এই রোগটায় যাঁরা গ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা দু’বেলা তাহারের পর পিপুলচরণ ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় জলসহ কয়েকদিন ব্যবহার ক’রে দেখতে পারেন; এর দ্বারা অগ্নিমান্দ্য নিশ্চয় উপশম হবে।
১০. বাতরোগে: তবে এ বাতে শ্লেষ্মর প্রাধান্য থাকবে। শুধু তাই নয়, প্রায়ই শরীরটা থম মেরে যায়, মনে হচ্ছে, এবার শরীর অচল হয়ে পড়বে। এই রকম পরিস্থিতিতে পিপুল চূর্ণ ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় ১ চা-চামচ আদার রস সহ সকালে ও বৈকালে দু’বার খেতে হবে। তবে আদার রসটা গরম করার পর তার ওপর থেকে ১ চা-চামচ ঢেলে নিতে হবে। আর একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, শরীরটা কড়া হয়ে যাচ্ছে এটা বুঝলে একবার করে খেতে হবে।
১১. প্লীহা বৃদ্ধিতে: এটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে চলেছে, তার আনুষঙ্গিক অন্যান্য লক্ষণগুলিও এসে পৌছচ্ছে, যেমন রক্তাল্পতা, আহারে অরুচি, দাস্ত অপরিষ্কার; সেক্ষেত্রে কুলেখাড়ার রস ৪/৫ চা-চামচ একট, গরম করে তার সঙ্গে ২০০ অথবা ২৫০ গ্রাম পিপুল চূর্ণ মিশিয়ে এক সপ্তাহ খেলেই এর উপকারিতা উপলব্ধি করতে পারবেন। অনেক প্রাচীন বৈদ্য এক্ষেত্রে কাঁচা দুধসহ পিপুল চূর্ণ খেতে দিয়ে থাকেন।
বৈজ্ঞানিক মতে পিপুল বাত উপশম করে, উত্তেজনা সৃষ্টি করে, রক্তশোধন করে এবং সারক (মল মূত্র বায়ু) নিঃসরণ করে।
তালজটা ভস্ম করার পদ্ধতি:
জটা তালগাছ থেকে কাঁচা জটা কেটে তাকে টুকরো করে শুকিয়ে নিয়ে হাঁড়িতে পুরে, সরা দিয়ে মুখ বন্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে নিতে হয়। তারপর সেটাকে মেড়ে মিহি করে নিলেই তালজটা ভস্ম প্রস্তুত হলো।
তালজটা ভস্ম প্রয়োগ: ২০০ মিলিগ্রাম এবং পিপুল চূর্ণ ২০০ মিলিগ্রাম একসঙ্গে মধুসহ খেতে হবে। তবে মধু ২৫/৩০ ফোঁটা মিশিয়ে নিয়ে তারপর তার সঙ্গে ২/৩ চা-চামচ দুধ মিশিয়ে খেতে পারলে ভালো হয়।
১২. মেধা হ্রাসে: পূর্বে মেধা ভালই ছিলো কিন্তু আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে— সেক্ষেত্রে পিপুল চূর্ণ ১৫০ মিলিগ্রাম, ২০/২৫ ফোঁটা ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে কিছুদিন খেয়ে দেখুন, নিশ্চয়ই উপকার পাবেন।
১৩. ঝুরা ক্রিমিতে: কি শিশু, কি বৃদ্ধ—এর উপদ্রব অনেককেই ভোগ করতে হয়। এজন্য ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় প্রত্যহ বিকালের দিকে বাসি জলসহ খাওয়া। এর দ্বারা অগ্নিবলও বেড়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে ক্রিমির উপদ্রবও কমে যাবে।
১৪. বার্ধক্যে: যাঁরা বয়সের ধর্মে বার্ধক্যগ্রস্ত হচ্ছেন কিন্তু তার সঙ্গে শ্লেষ্মার বিকারজনিত রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা সকালে ও বৈকালে দু’বার বাসক পাতার রস ৩/৪ চা-চামচের ২৫০ গ্রাম পিপুল চূর্ণ মিশিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তবে বাসক পাতার রসটা একট, গরম করে নিতে হবে। এর দ্বারা আংশিক উন্নতি তো হবেই।
১৫. জ্বরে: ক্ষয়মুলক জ্বরেও ১০ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন একটি করে বাড়িয়ে খেয়ে যেতে হবে, তারপর প্রত্যহ একটি করে কমিয়ে খাওয়া বন্ধ করতে হবে। এই সময় পথ্য দুধ-ভাত (পুরনো ধানের চালের ভাত)। অল্প গাওয়া ঘি মিশিয়ে খাওয়ার উপদেশ। আর একট, বক্তব্য এই পিপলগুলির মাত্রা কিন্তু ১০টি দানা থাকবে এতটকু পিপল, এতটুকু পরিমাণ পিপল নিয়েই এর একক মাত্রা। এই রকম প্রতিদিন একটি করে বাড়িয়ে যেতে হবে।
CHEMICAL COMPOSITION
Piper longum Linn. 1. Piperine. 2. Piperlonguminine. 3. Piperlongumine (O=Piplartine) 4. N-Isobutyl deca-trans-2-trans-4-dienamide. 5. Sesamine 6. Diaendesmine. 7. l-Undecyl-3, 4-methylenedioxybenzene 8. Piplasterol. 9. Terpinolene. 10. p-cymene. 11. Dihydrocarveol 12. OC-Thujene. 13. Zingiberene. 14. B-Caryophyllene. 15. n-Eicosane. 16. n-Heptane. 17. n-Hexadecane. 18. n-Hexeicosane. 19. nNonadecane. 20. n-Octadecane. 21. p-Methoxy-acetophenone 22. Phenyl ethyl alcohol.[১]
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৬১-৬৩।
২. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, ২৫৬-২৫৭।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।