আনাতোলি ভাসিলিয়েভিচ লুনাচারস্কি (রুশ ভাষায়: Анато́лий Лунача́рский; ১১ নভেম্বর ১৮৭৫ – ২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৩) ছিলেন একজন রাশিয়ান মার্কসবাদী বিপ্লবী এবং প্রথম বলশেভিক সোভিয়েত পিপলস কমিশারের (নরকম্প্রোস) শিক্ষামন্ত্রী, পাশাপাশি পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে ছিলেন সক্রিয় নাট্যকার, সমালোচক, প্রাবন্ধিক এবং সাংবাদিক। রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যতম নেতৃস্থানীয় সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিস্তারে লুনাচারস্কির অবদান অমূল্য।
জনশিক্ষা কমিশারিয়েতে যোগদান
জনশিক্ষা কমিশারের পদে লুনাচারস্কিকে মনােনীত করেন স্বয়ং লেনিন এবং তিনি শিক্ষাক্ষেত্রের অন্যান্য নামী ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে একযােগে সােভিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠার গােড়ার দিকের সেই দুঃসময়ের অতি কঠিন পরিস্থিতিতে একটি নতুন শিক্ষাপ্রণালীর ভিত্তিস্থাপন সহ সােভিয়েত স্কুল, গঠনের তত্ত্বীয় ও প্রায়ােগিক মূলনীতি উদ্ভাবনে সফল হন! লেনিনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে লুনাচারস্কি সমন্বিত, পলিটেকনিকাল শ্রম-স্কুলের নীতিগুলি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন এবং তাঁরই উদ্যোগে প্রাক স্কুল শিক্ষার এক ব্যাপক প্রণালী, পেশাভিত্তিক ও উচ্চতর শিক্ষা এবং সাধারণ সংস্কৃতি ও শিক্ষালগ্ন নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদে মূলীভূত থাকা এবং শিক্ষা-সমস্যাকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট করার মধ্যেই লুনাচারস্কির শিক্ষানীতিগুলির শক্তি ও প্রত্যয়ের উৎস নিহিত ছিল। তাঁর প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী স্কুলব্যবস্থা সংগঠনের নিবিড় বৈজ্ঞানিক, মার্কসীয় ধরনকে প্রয়োগ ও সত্যায়ন করে, শিক্ষার লক্ষ্যকে, শিক্ষণের আধেয় ও প্রণালীর চাহিদাকে চিহ্নিত করে। স্কুল ও জীবনের সম্পর্ক, ব্যষ্টি ও সমষ্টির সম্পর্ক, ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক ইত্যাকার গুরুত্বপর্ণ শিক্ষাসমস্যা সমাধানে লুনাচারস্কির অবদান উল্লেখযােগ্য। ব্যক্তির স্বকীয়তার সর্বতােমুখী বিকাশকেই লুনাচারস্কি শিক্ষার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত এবং শিক্ষার মূল লক্ষ্য ভাবতেন।
লুনাচারস্কি মনে করতেন যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তিই চরম মূল্যবান সত্তা। তাঁর ভাষায় ‘আমরা চাই একজন মানুষকে এই শিক্ষা দিতে, যে মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম সমন্বয়ে উত্তীর্ণ হবে, সে যথাসম্ভব পূর্ণ শিক্ষা পাবে; যে কোন একটি ক্ষেত্রে সহজেই অত্যুচ্চি দক্ষতা লাভ করতে পারবে। এমন এক ধরনের মানুষ তৈরিও আমাদের লক্ষ্য, যে হবে সহনাগরিকদের সত্যিকার সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, অন্য সকল মানুষের জন্য একজন কমরেড আর সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের জন্য সংগ্রাম চলাকালে একজন যােদ্ধা তৈরিই আমাদের উদ্দিষ্ট।'[১]
লুনাচারস্কির যাবতীয় কার্যকলাপেই গভীর বিশ্বাস এবং উজ্জল ও সুন্দর ভবিষ্যতের উপস্থিতি সহজলক্ষ্য। গৃহযুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট ও দুর্ভিক্ষের সেই দুর্দিনের বছরগুলিতেও আদর্শ মানুষ সৃষ্টির স্বপ্ন তিনি ত্যাগ করেন নি, যে-মানুষ হবে ‘দৈহিক দিক থেকে সুন্দর, সমন্বিতভাবে বিকাশমান, সুশিক্ষিত এবং প্রযুক্তি, চিকিৎসা, দেওয়ানী আইন, সাহিত্য ইত্যাকার দুরবিচ্ছিন্ন বিদ্যাসমূহের অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আর মূল তথ্যাদি সম্পর্কে অবহিত।
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্বচ্ছদষ্টি, সমাজতন্ত্র নির্মাণের সম্ভাবনার আলােকে জরুরি কার্যাদির সমাধান উদ্ভাবন – এই তাে লুনাচারকির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কালবিশেষের অসুবিধাগুলির শান্ত মূল্যায়ন কখনই তাঁর ভবিষ্যৎ দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে নি। তিনি বলতেন বর্তমান সময়ের অসুবিধাগলি দিয়ে আমরা প্রলেতারিয়েতের সর্বোত্তম আকাঙক্ষার ফুলগলিকে — মানুষের সার্বিক বিকাশের সম্ভাব্যতাকে পিষে ফেলতে পারি না।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকেই লুনাচারস্কি সাধারণ শিক্ষার বৈশিষ্ট্যচিহ্নিত সমাজতান্ত্রিক স্কুলের জন্য এবং এটিকে পলিটেকনিকাল স্কুল হিসাবে গড়ে তোলার জন্য লড়াই করেছেন।[১]
তথ্যসূত্র:
১. মিখাইল প্রকোফিয়েভ, আনাতোলি লুনাচারস্কি নির্বাচিত প্রবন্ধ ও বক্তৃতা সংকলন, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৮৬ পৃষ্ঠা ৫-৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।