ক্লদ লেভি স্ট্রস (২৮ নভেম্বর ১৯০৮ – ৩০ অক্টোবর ২০০৯) ফরাশি সমাজ নৃতত্ত্ববিদ এবং সাহিত্য বিশ্লেষণে ‘সাংগঠনিকতত্ত্বের’ অন্যতম প্রবক্তা। লেভি-স্ট্রস ১৯০৮ সনের ২৮শে নভেম্বর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে জন্মগ্রহণ করে। ১৯৩২ সনে তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সন পর্যন্ত সময়ে ব্রাজিলের সান পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে তিনি মাটো গ্রাশোতে ভারতীয় সংস্কৃতি গবেষণায় বহু নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯৪১ সন থেকে ১৯৪৭ সন পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। এ সময়ে তিনি নিউ ইয়র্কে New School for Social Research-এ ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে এবং ফরাশি সাংস্কৃতিক এটাশে হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৯ সনে তিনি প্যারিসে ফিরে আসেন এবং Music de I homme-তে পরিচালক নিযুক্ত হন। পর বৎসরে তিনি প্যারিসের Ecole pratique des hautes etusates-এ সমাজ-নৃতত্ত্বের গবেষণাগারে গবেষণা পরিচালকের পদ লাভ করেন। ১৯৫৯ সন পর্যন্ত তিনি College de France-এ সমাজ-নৃতত্ত্বের অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃত করেন।
লেভি স্ট্রসের মূল চিন্তা ছিল এই যে, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মাচার, পুরাণ, সংগীত, ভাষা ইত্যাদি হল বিশ্বজনীন চিন্তন প্রক্রিয়া। মানুষের মন এমন এক সুবিন্যস্ত যন্ত্র, যার সকল অভিজ্ঞতাতেই সুশৃঙ্খল সংগঠনের (ordered structure) ছাপ পড়ে। এর ফলে মানুষ পরিবেশ সংক্রান্ত যে ধারণা পায় বা মানুষের লক্ষে পরিবেশ সংক্রান্ত যেসব ধারণা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ওঠে তা বিবিধ বিশ্লিষ্ট উপাদানের হলেও নিয়মিতভাবে বিন্যস্ত। মানুষের মনের বৈশিষ্ট্যদ্যোতক এই একই সংগঠন বা বিন্যাস সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চসমূহ বা সাংস্কৃতিক প্রকাশসমূহের মধ্যে অন্বেষ্য। তাই লেভি-স্ট্রস সংগঠনের যৌক্তিক-আঙ্কিক ধারণা ব্যবহার করে সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চসমূহ অর্থাৎ এইসব প্রপঞ্চের উপাদানের মধ্যকার সম্পর্কের বিদ্যাসমূহকে তুলনা করেছেন।
ক্লদ লেভি স্ট্রস প্রথমে সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চের বিমূর্ত আদর্শ সৃষ্টি করে নেন। এর পর ঐ প্রপঞ্চগুলোর মধ্যে তুলনা না করে প্রপঞ্চের জন্য সৃষ্ট আদর্শগুলোর মধ্যে তুলনা করেন। বিশ্লেষণের এই বিমূর্ত ধরনটি সাংগঠনিক তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। এই ধরনটি অভিজ্ঞতাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। লেভি স্ট্রসের মতে কেবল সীমিত সংখ্যক পন্থাতেই সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চকে সংগঠিত করা যেতে পারে।
‘প্রাগ্রসর’ বা ‘আদিম’ ধরনের সমাজ-বিভাজনকে বর্জন করেন তিনি। তিনি সমাজ বিভাজন করেন কোনো সমাজের প্রযুক্তিগত প্রাগ্রসরতার মানদণ্ডে। অর্থাৎ অর্থনীতি যে ভিত্তি, এই কথা তিনি বোঝেন না, ফলে সমাজ যে পরিবর্তনশীল, এই বোধ তাঁর ছিলো না। তাঁর জনপ্রিয় একটি কথা হচ্ছে, “জ্ঞানী মানুষ সঠিক উত্তর দেন না, তিনি সঠিক প্রশ্নগুলি জাহির করেন।” তবে কারো মনে প্রশ্ন কেন আসে, বস্তু থেকে যে চিন্তার উদয়, এইসব বিষয়ে এই নির্বোধের কোনো বোধ ছিল না।
সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান দ্বারা লেভি-স্ট্রসের সংগঠনের ধারণা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। তার মতে সংস্কৃতির অবাচিক (nonverbal) দিকগুলো (যেমন পণ্য ও সেবা বিনিময়) যোগাযোগের সাংকেতিক প্রণালী গড়ে তোলে, যাকে ভাষার মতই বিশ্লেষণ করা যায়। এই ধারণা সংস্কৃতির বাচিক এবং অবাচিক দিকগুলোর আন্তঃসম্পর্কের জটিলতা বিষয়ে আলোকপাত করে এবং নতুন মাত্রা প্রদান করে।
লেভি-স্ট্রসের গ্রন্থগুলি হচ্ছে : Elementory Structure of Kinaship (১৯৬৭), Structural Anthropology, (১৯৬১), Totemism (১৯৬১), The Savage Mind (১৯৬২), The Raw and the Cooked (১৯৬৪), From Honey to Ashes (১৯৬৬), The Origin of Table Manners (১৯৬৮), The Naked Man (১৯৭১), Myth and Meaning (১৯৮০)।
তথ্যসূত্র:
১. আফজালুল বাসার; বিশ শতকের সাহিত্যতত্ত্ব; বাংলা একাডেমী, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১; পৃষ্ঠা ৩০০-৩০১।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।