লেখক ধনঞ্জয় রায় ১৯৫৩ সালের ১ জানুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার বড়বন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দিনাজপুরের গিরিজানাথ হাইস্কুল, সুন্দরী হাইস্কুল ও নৈহাটীর ঋষি বঙ্কিম কলেজে শিক্ষালাভ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। জমিদার-তালুকদার-জোতদার পরম্পরা-পীড়িত বঙ্গে প্রজা ও কৃষকদের ধুমায়িত ক্রোধের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ইতস্তত বিস্ফোরণ উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকেই দৃষ্টিগােচর হচ্ছিল। বিশ শতকের তৃতীয় দশকের সূচনা থেকে এই ধরনের যত বিস্ফোরণ তা বৃহত্তর গণান্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে আরম্ভ করে, এবং রাজনৈতিক দলগুলি প্রজা কৃষকদের ভেতর তাদের যার যার প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে কৃষক-সংগঠন ও কৃষকান্দোলন বর্ধনে ব্রতী হয়। কৃষক আন্দোলনের এই গােড়ার ইতিহাস লিখেছেন লেখক ধনঞ্জয় রায়।
ধনঞ্জয় রায় পৌন্ড্রবর্ধন ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সভাপতি এবং পাক্ষিক কালিয়াগঞ্জ বার্তার সম্পাদক। তার লেখা ‘দিনাজপুর মালদহের মিশনারি যুগ’ নামক বইটি এই লেখক ৩ অক্টোবর ২০১২ সালে নীলখেত, ঢাকার ফুটপাত থেকে মাত্র ১০ টাকায় কিনেছিলেন। তার উপর আগ্রহ থেকেই তাঁর সম্পর্কে আমরা জানছি। দিনাজপুর জেলার ইতিহাস তাঁর একটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ।
তাঁর রচিত বইয়ের তালিকাটি হচ্ছে: ১. দিনাজপুর মালদহের মিশনারি যুগ, ২. উত্তরবঙ্গের লোকজীবন চর্চা, ৩. উত্তরবঙ্গের ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন, ৪. দেবদারু বনে আগুন, ৫. প্রান্তরে নৈশ বৈরাগ্য, ৬. বঙ্গদেশের উত্তরপ্রান্তীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারা, ৭. উত্তরবঙ্গের আধিয়ার বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলন (সম্পাদিত), ৮. তরাই-ডুয়ার্সের শ্রমিক-কৃষক বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলন (সম্পাদিত), ৯. রংপুরের আধিয়ার বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলন (সম্পাদিত), ১০. তেভাগা আন্দোলন, ১১. উত্তরবঙ্গ (উনিশ ও বিশ শতক), ১২. বিশ শতকের দিনাজপুরঃ মন্বন্তর ও কৃষক আন্দোলন, ১৩. দিনাজপুর জেলার ইতিহাস।
তেভাগা আন্দোলন প্রসঙ্গে
ধনঞ্জয় রায় অনেকগুলো কাজ করেছেন তেভাগা আন্দোলন-এর উপর। মূলত এই লেখক উত্তরবঙ্গের কৃষক ও শ্রমিকদের সংগ্রামকে তুলে ধরতে চেয়েছেন তাঁর অনেক লেখায়। সামাজিক রাজনৈতিক বিবর্তনের একটি বিশেষ পর্যায়ে উত্তরবঙ্গে, দিনাজপুর-রংপুর-জলপাইগুড়ি-কোচবিহার-মালদহ, এই পাঁচটি জেলার নানা জায়গায়, কৃষককুলের আক্রোশ স্থানীয় বিদ্রোহ ও বিরােধান্দোলনে পরিণতি লাভ করে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি তখন জনযুদ্ধে’ উৎসর্গীকৃতপ্রাণ; খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই রাজনৈতিক গােষ্ঠী এই বিরােধান্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সময়টা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তিম অধ্যায়, আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার পূর্বাহ্ন। তখনকার সাময়িক ইতিহাসে, এখনকার স্মৃতিতে এই বিরােধের প্রথম অধ্যায় আধিয়ার বিদ্রোহ, দ্বিতীয় অধ্যায় তেভাগা আন্দোলন নামে খ্যাত। যেমন তিনি ‘তেভাগা আন্দোলন’ সংকলনটি ভূমিকায় লিখছেন:
“‘তেভাগা আন্দোলন’ সংকলনটি প্রস্তুত করার বেশ কয়েক বছর আগে ‘উত্তর বঙ্গের আধিয়ার বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলন’, ‘রংপুরের আধিয়ার বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলন’ এবং ‘তরাই ডুয়ার্সের শ্রমিক কৃষক বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলন’ নামে তিনখানি বই আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বই তিনটি একত্রিত করে তেভাগা আন্দোলন’ নামে প্রকাশিত হল। অসুবিধার জন্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ননীগােপাল দাস মহন্ত-এর ‘তেভাগা আন্দোলনের ইতিকথা’, দীনেশ লাহিড়ীর ‘রংপুরের তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতি’ ও বীরেন্দ্রকুমার নিয়ােগীর আরও একটি লেখা ‘মাধব দত্ত স্মরণে এবং তেভাগার গানগুলি সে সময় প্রকাশ করতে পারিনি, ওইগুলি এ সংকলনের বাড়তি সংযােজন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে আচার্য নীহাররঞ্জন রায় ‘উত্তরবঙ্গের আধিয়ার বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলন এবং ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক অমলেন্দু দে ‘রংপুরের আধিয়ার বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলন’ বইয়ের জন্য ভূমিকা লিখেছিলেন। তাঁদের উভয়ের কাছে আমি ঋণী। সেই দুটি ভূমিকা বর্তমান সংকলনের প্রারম্ভে যুক্ত করা হয়েছে।”[১]
ধনঞ্জয় রায় উত্তরবঙ্গবাসী, স্থানীয় ইতিহাস-পিপাসু, জনজীবননিবদ্ধচিত্ত একজন প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত শিক্ষকমাত্র। তিনি এই কৃষক বিদ্রোহ ও বিরােধান্দোলন সম্বন্ধে উৎসাহিত হয়ে তার ইতিহাস জানবার ঔৎসুক্যে, যাঁরা এই বিদ্রোহ ও বিরােধান্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন অনেককে অনুরােধ করেছিলেন তাঁদের নিজ নিজ জ্ঞাত তথ্য ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে তাঁকে দেবার জন্যে যাতে তিনি সেগুলাে একত্র করে সম্পাদন ও প্রকাশ করতে পারেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁর বিনীত আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। ধনঞ্জয়বাবু পরমােৎসাহে, অপরিসীম কৃতজ্ঞতায়, নিজের দুঃখকষ্টার্জিত অর্থে এবং স্বার্থপ্রয়ােজনাতিরিক্ত উদ্যোগে তাঁদের এই লিখিত বিবরণগুলি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছেন।
দেশভাগের বিপর্যয়ের ফলে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নেতারা ও কর্মীরা এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন যে, তাঁদের স্মৃতিকথা সংগ্রহ করা বেশ কষ্টকর। অথচ তাঁদের কথা জানতে না পারলে ‘এলিট’ বা ‘উচ্চবর্গে’র আত্মত্যাগী মানুষের সঙ্গে ‘সাবঅলটার্ন’ বা ‘নিম্নবর্গের অগণিত জনসাধারণের একাত্মতাবােধের চিত্রটি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে না। কতটা ব্যাপক পরিধি ও গভীরতা নিয়ে এই একাত্মতাবোেধ সমাজ পরিবর্তনের পথটিকে প্রশস্ত করেছিল তার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের জন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নির্ভর স্মৃতিকথা খুবই সহায়ক। সঙ্কলক শ্রীধনঞ্জয় রায় এমনি একটি মূল্যবান গ্রন্থ আমাদের উপহার দিয়েছেন।
ধনঞ্জয় রায় দীর্ঘকাল ধরে গবেষণার কাজে নিযুক্ত আছেন। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে তাঁর বন্ধন অন্তরের। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের কাহিনীগুলাে যাতে বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে না যায় তার জন্য তিনি অনলস পরিশ্রম করে চলেছেন। তিনি একক প্রচেষ্টায় বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষক সংগ্রামের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে কয়েকটি প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেছেন।
তথ্যসূত্র:
১. ধনঞ্জয় রায় সম্পাদিত, তেভাগা আন্দোলন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, পৃষ্ঠা ৮-১৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।