এপিকিউরাস প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিক

এপিকিউরাস বা এপিকুরোস বা এপিক্যুরাস (ইংরেজি: Epicurus; ৩৪১-২৭০ খ্রি. পূ.) প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিক এবং নীতিশাস্ত্রের এপিক্যুরিয়ানিজম বা প্রাচীন সুখবাদের প্রতিষ্ঠাতা। প্রাচীন গ্রিসে এপিক্যুরিয়ানিজম-এর প্রতিদ্বন্দ্বী মত ছিল স্টয়েসিজম বা বৈরাগ্যবাদ।

এপিক্যুরাস একনিষ্ঠ জ্ঞান-গবেষক ছিলেন। ৩১০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে তিনি মাইটিলেন নামক স্থানে তাঁর দর্শনাগারের প্রতিষ্ঠা করেন। সুখবাদ বলতে নির্বিচারে ইন্দ্রিয়াসক্তি এবং স্থূল সুখভোগের ধারণা এপিক্যুরাসের নীতিবাদের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে। কিন্তু এপিক্যুরাসের নিজের জীবনের মিতব্যবহার, সরল জীবন যাপন এবং সুখ সম্পর্কে তাঁর নিজের ব্যাখ্যা এরূপ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে গ্রিসের সর্বস্থান হতে দর্শন শিক্ষার্থীগণ তাঁর শিক্ষাগারে এসে জমায়েত হতে থাকে। এদের মধ্যে প্রভুদের প্রাসাদের নর্তক এবং দাস সম্প্রদায়ের লোক, এমনকি মহিলাদের সাক্ষাৎও পাওয়া যায়।

নীতিবাদই এপিক্যুরাসের দর্শনের মূল। তাঁর কারণ, এপিক্যুরাস মনে করতেন, জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের জীবনযাপনের এমন নীতি স্থির করা যে নীতিতে মানুষ সত্যকার শান্তিলাভে সক্ষম হবে। যথার্থ দর্শনের কাজ হবে মানুষের জীবনের যন্ত্রণা নিবারণ করা। মানুষের যথার্থ শান্তি কিসে? এ প্রশ্নের উত্তরের পূর্বে স্থির করতে হবে মানুষের কর্মের মূল চালক কি? এপিক্যুরাসেরমতে মানুষের কর্মের উৎস হচ্ছে সুখের আকাঙ্ক্ষা এবং দুঃখের পরিহার। মানুষ স্বভাবগতভাবেই মুখের কামনা করে, সুখের অন্বেষণ করে এবং দুঃখকে পরিহার করতে চায়। কিন্তু যে- কোনো সুখই সুখ নয়। আপাতদৃষ্টিতে যা সুখময় মনে হবে, তা পরিণামে সুখদায়ক না হয়ে যন্ত্রণার কারণও হতে পারে। এজন্য মানুষকে বিবেচক হতে হবে এবং যথার্থ সুখের অন্বেষণ করতে হবে। তাকে কোনো কিছু উপভোগের ফলাফল চিন্তা করতে হবে।

প্রজ্ঞা বা বিবেচনাই হচ্ছে মানুষের জীবনের হিতের মহৎ উপায়। মানসিক সুখ আর দৈহিক সুখ বলে সুখকে বিভক্ত করে দৈহিক সুখকে স্থূল আর মানসিক সুখকে বিমল ভাবার কোনো কারণ নেই। সব সুখের উৎস হচ্ছে দেহ। ক্ষুধার তৃপ্তিতেই সুখের শুরু। দেহের ক্ষুধা নিবৃত্ত না হলে মনের সুখ আদৌ আসতে পারে না। কিন্তু অবিমিশ্র মাত্রাতিরিক্ত দৈহিক সুখও যথার্থ সুখ নয়। কারণ অবিমিশ্র দৈহিক সুখ পরিণামে যন্ত্রণা ও ক্লেশের উদ্ভব ঘটায়। কাজেই দৈহিক সুখেরও পরিমাণ থাকতে হবে।

আরো পড়ুন:  এরাটোসথেনিস আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গ্রন্থাগারিক এবং ব্যাকরণবিদ

এপিকিউরাসের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, পরিমিতি এবং ভারসাম্য বজায় রাখাই হচ্ছে মানুষের সর্বাধিক কর্তব্য। জীবনের যে ক্ষুধা অপরিহার্য এবং স্বাভাবিক কেবল তাকে তৃপ্ত করাই হবে মানুষের পক্ষে সঙ্গত। চরম সুখ, চরম উপভোগ নয়। চরম সুখ হচ্ছে সমস্ত প্রকার অভাব ও ক্লেশমুক্ত অবস্থা। এপিকিউরাসের এই সুখতত্ত্ব যে আদৌ নির্বিচার ইন্দ্রিয় ভোগের তত্ত্ব নয়, একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

বস্তুত এপিক্যুরাসের নীতি নির্দেশে যৌন ভোগ পরিহার করার উপদেশেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন, এপিক্যুরাস তাঁর বস্তুবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদী মন দিয়ে সুখকে জীবনের প্রধান কাম্য মনে করলেও তিনি পিরহোর বৈরাগ্যবাদ দ্বারা বিশেষ প্রবাবিত হয়েছিলেন আর তাই তাঁর নীতি দর্শনে তিনি মানুষকে জীবনের প্রয়োজন বৃদ্ধি করার বদলে সীমিত করার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর অনুসারীদের তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণার নিরত হতে এবং তার মধ্যে জীবনের শান্তি লাভের আহবান জানিয়েছেন। এপিকিউরাসের নীতিবাদ কোনো সামাজিক তত্ত্ব নয়। এ তত্ত্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিক।

সুখবাদ বা নীতি-তত্ত্ব এপিকিউরাসের দর্শনের কেন্দ্র হলেও তাঁর মনের জিজ্ঞাসা ছিল বিচিত্রমুখী। সত্যের মাপকাঠি কি, বস্তুর মূল সত্তা কি, আত্মা কীভাবে গঠিত, ইত্যাদি বিষয়েও তাঁর মতামত সুস্পষ্ট ছিল। মানুষ দৃশ্য থেকে অদৃশ্য সম্পর্কে অনুমান করে। মানুষের কাছে দৃশ্য এবং প্রত্যক্ষ হচ্ছে তার ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা। ইন্দ্রিয়ানুভূতি প্রত্যক্ষ বলে ইন্দ্রিয়ানুভূতি হচ্ছে মানুষের জ্ঞানের যথার্থতা বা সত্যের পরিমাপক। মন হচ্ছে ইন্দ্রিয়-লব্ধ অনুভূতির সংগ্রহশালা। এই সংগ্রহশালা থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে মন বিশ্লেষণ, পরিমাপ, তুলনা, অনুমান ইত্যাদির ক্ষমতা অর্জন করে। বস্তুর সার বা মূলের প্রশ্নে ডিমোক্রিটাস (৪৬০-৩৭০ খ্রি. পূ.) এর ন্যায় এপিক্যুরাসও অনুতত্ত্বের অভিমত প্রকাশ করেন।

এপিকিউরাস মনে করতেন যে, বস্তুর মূলে আছে অচিন্তনীয় রূপে সূক্ষ্ম আঁকারের অবিভাজ্য সংখ্যাহীন অণু। অণু পরিবর্তনীয় এবং দুর্ভেদ্য। অসীম শূন্যে ঘূর্ণ্যমান অণুর আকস্মিক সংযোগ এবং বিয়োগে সংখ্যাহীন বিচিত্র সৃষ্টির নিয়ত উদ্ভব এবং ধ্বংস সাধিত হয়। এপিকিউরাস ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। তিনি বলতেন, মানুষকে ভূত, ভগবান এবং পরকালের ভীতি থেকে মুক্ত করতে পারলেই তাঁর মধ্যে সত্যকার সৎচরিত্রের সৃষ্টি সম্ভব হবে এবং মানুষ পরম শান্তি লাভ করতে সক্ষম হবে।

আরো পড়ুন:  লাইসিয়াম এ্যরিস্টটলের দর্শনাগার বা একাডেমী

ডিমোক্রিটাসের বিখ্যাত মনোবিদ্যারও বিকাশ ঘটে এপিক্যুরাসের হাতে। তিনি মানুষের মন বা আত্মাকে দুইভাগে বিভক্ত বলে মনে করেন। এক ভাগে হচ্ছে তার যুক্তির ভাগ। এ ভাগের অবস্থান মানুষের হৃদয়ে। মানুষের এ অংশে বিচিত্র প্রকারের অণু জটিল গতিতে সংযোজিত হয়ে মানুষের চিন্তা, ইচ্ছা, আবেগ প্রভৃতি বোধের সৃষ্টি করে। মনের অপর ভাগ হচ্ছে স্থূল বা অযুক্তির ভাগ। দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে এ ভাগের গঠন এবং এর অণুগুলি তত দৃঢ় সংযোজনে আবদ্ধ নয়। কিন্ত মানুষের এই দুই অংশ নিয়েই তার সমগ্র কাঠামো গঠিত। মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। দর্শনের ইতিহাসে এপিকিউরাস-এর নাম সঙ্গতিপূর্ণ বস্তুবাদী দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম দার্শনিক হিসাবে প্রখ্যাত হয়ে আছে।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!