ঊনবিংশ শতকের জার্মানীর ভাববাদী দার্শনিক ফ্রিডরিক নিৎসে বা ফ্রিডরিখ নিটশে (ইংরেজি: Friedrich Nietzsche; ১৮৪৪-১৯০০ খ্রি.) ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের অন্যতম পূর্বসূরি ছিলেন। ইউরোপে পুঁজিবাদ তখন সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করতে শুরু করেছে। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অসঙ্গতি ও সংকট সমাজের অভ্যন্তরে শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্বকে তীব্র করে সামাজিক বিপ্লবকে অত্যাসন্ন করে তুলছে। এই বাস্তব পরিবেশে পুঁজিবাদের আত্মরক্ষার এবং প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবের আদর্শগত প্রতিভূ হিসেবে নিৎসের অভিমত প্রকাশিত হয়। নিৎসের দর্শনের মধ্যে তাই জনতা এবং বিপ্লবী মতাদর্শের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার ভাব সুস্পষ্ট।
নিৎসের দর্শনের মূল কথা হচ্ছেঃ প্রকৃতি ও প্রাণিজগতে নিরন্তর আত্মরক্ষা ও বাঁচার সংগ্রাম চলছে। এই বাঁচার সংগ্রামের পরিণাম হচ্ছে ক্ষমতা বিস্তারের অদম্য ইচ্ছা। তাই শোষক, শোষিত বা দাস, প্রভু এগুলি প্রকৃতিগত ব্যাপার। শোষণ করা জীবনমাত্রেরই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য আর দাস হওয়াটাও বাঁচার সংগ্রামে পরাজিত পক্ষের অনিবার্য্য ভাগ্য। পরাজিতের পক্ষে দাসত্ব স্বীকার করা হচ্ছে বাস্তব সত্যের স্বীকৃতি। কিন্তু বাঁচার সংগ্রাম স্বাভাবিক এবং পরাজয়ের পরে দাসত্ব অনিবার্য বলে নিৎসে ঊনবিংশ শতকের ধনবাদী শোষককে ভবিষ্যতের অনিবার্য দাসত্বকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করেন নি। তাকে সংগ্রামের পরিণামে অনিবার্য পরাজয় থেকে বাঁচবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন তার প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বের মারফত। এই উদ্দেশ্য নিয়ে ধনবাদী সভ্যতার প্রথম যুগের প্রগতিশীল বুদ্ধিবাদ, উদারতাবাদ, মানবতাবাদ প্রভৃতি ভাবধারাকে দুর্বলচিত্ততা বলে তিনি আখ্যায়িত করেছেন।
নিৎসের মতে উদারতাবাদ, মানবতাবাদ প্রভৃতি ভাবধারা আসন্ন বিপ্লবকে রোধ করতে অক্ষম। আসন্ন বিপ্লবকে রোধ করতে হলে সমাজের শক্তিধরদের নিজেদের চরিত্রে কাঠিন্য, সাহস, দৃঢ়তা সৃষ্টি করতে হবে। তাদের নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন হতে হবে। গণতন্ত্র এবং মানবতাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। বস্তুত এই সংকট থেকে সমাজকে রক্ষা করতে পারবে একমাত্র অতিমানুষ যে তার উদ্দেশ্য সাধনে কোনো গণতন্ত্র এবং মানবতাবাদী নীতিরই পরোয়া করবে না।
নিৎসের অতিমানুষের আদর্শই বাস্তবায়িত হয়েছিল বিংশ শতকের তৃতীয় শতকে ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থানে এবং তার মনুষ্যত্বের বর্বর নায়ক এ্যাডলফ হিটলারের চরিত্রে। নিৎসে দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণীকে বশে রাখতে হলে তার মধ্যে দাসত্বের মনোভাব এবং পুঁজিবাদী প্রভুদের মাঝে প্রভুত্বের মনোভাব সৃষ্টিতে করতে হবে। নিৎসের মতে বিশ্বে অগ্রগমন বা বিবর্তন বলে কোনো সত্য নেই। বিশ্বে চলছে বিশেষ বিশেষ অবস্থার পৌনঃপুনিক পুনরাবর্তন। ‘জারাথ্রুস্ত্র বললেন’ ‘হিত অহিতকে অতিক্রম করে’ এবং ‘উইল টু পাওয়ার’ বা শক্তির সংগ্রাম নিৎসের গ্রন্থসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৯৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।