চিয়াং চিং (Jiang Qing; ১৯ মার্চ, ১৯১৪ – ১৪ মে, ১৯৯১) বিশ্বের মাওবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এক সর্বহারা শ্রেণির মহীয়সী নেত্রীর নাম। তিনি সানতু প্রদেশের এক শ্রমজীবী পরিবারে ১৯১৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন যে সময় পশ্চাৎপদ সামন্তবাদী চিনা নারীরা শোষণ নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে পুনর্জন্মে কুকুর হয়ে জন্মগ্রহণ করতে চাইতেন। শৈশব থেকে দারিদ্র ও অনাহারে বেড়ে ওঠা চিয়াং চিং প্রথমে ক্ষুধা নিবারণের জন্য একটি নাট্যদলে যোগদান করেন। এবং পরবর্তীতে রাজধানী পিকিং চলে আসেন।
পিকিংয়ে তাঁর জীবনের মোড় পালটে যেতে শুরু করে যখন জাপানি সাম্রাজ্যবাদীরা মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়। ১৯৩১ সালে তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত বামপন্থী নাট্যদলে যোগদান করেন এবং ১৯৩৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। কমরেড চিয়াং চিং-এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন না থাকলেও এ সময় তিনি প্রচুর পরিমাণে মার্কসবাদ লেনিনবাদের ওপর অধ্যয়ন করেন। লাইব্রেরিতে চাকরিরত অবস্থায় সমাজবিজ্ঞানের উপর ব্যাপক পড়াশোনা ও গবেষণা করেন।
১৯৩৩-এর বসন্তে তাকে সাংহাইতে নিয়োগ করা হলো, যখন কিনা মাও-লাইনের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী ওয়াং মিং ও তার শহরকেন্দ্রিক লাইনের প্রভাবে পার্টি কাঠামো ধ্বংসপ্রায় এবং সুবিধাবাদ ছড়িয়ে পড়ছিলো। চিয়াং চিং সাংহাইতে প্রথম কাজ শুরু করেন মঞ্চ অভিনেত্রী হিসেবে। এখানে তিনি কয়েকটি প্রগতিশীল নাটক মঞ্চস্থ করেন। এতে দরিদ্র শ্রেণির জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। একই সাথে তিনি নারী শ্রমিকদের মাঝেও কাজ করেন। শ্রমিকদেরকে তিনি সচেতন করে তোলেন যে কীভাবে বৃটিশ ও জাপানি মালিকানাধীন কাপড়ের মিল ও সিগারেটের কারখানাগুলোতে শ্রমচুক্তির দুরবস্থা চলছে। এখান থেকেই তিনি শত্রুর হাতে গ্রেফতার হন এবং আট মাস জেল খেটে জেলরক্ষীদের বোকা বানিয়ে পালিয়ে আসেন।
চিয়াং চিং যখন দেখেন যে, দু’চারটি চলচ্চিত্র বাদে সমস্ত চলচ্চিত্র পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিক্রিয়াশীল কেন্দ্র হলিউড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তখন তিনি আওয়াজ তোলেন “জাতীয় বিপ্লবের জন্য জনগণের সাহিত্য”। শিল্পকলার ক্ষেত্রে কমরেড মাও এই আওয়াজকে অনুমোদন করেন। সাংহাই শহর জাপানিরা আক্রমণ করলে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম রুট বাহিনীতে তিনি যোগ দেন এবং ৩০০ মাইল পাহাড় পায়ে হেঁটে ইয়েনানে পৌঁছান। ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে চিয়াং চিং – এর সাথে মাও সেতুং-এর বিয়ে হয়। পরবর্তীতে তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে।
পরবর্তী বছরগুলোতে চিয়াং চিং চিনা কমিউনিস্ট পার্টিতে একাগ্রচিত্তে কাজ করেছেন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে মাও-এর পাশে থেকে লড়াই করেছেন। ১৯৪৯ সালে চিনা পার্টি ক্ষমতায় এলে তথা সর্বহারা শ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা কায়েম হলে কমরেড চিয়াং চিং সাংহাইতে ভূমি সংস্কার কর্মসূচিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এক্ষেত্রেও তিনি নারীদেরকে অসম ভূমি, খারাপ ও পতিত ভূমি দেয়ার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ব্যাপক সংগ্রাম পরিচালনা করেন। ১৯৫০ সালে চিয়াং চিং-এর গবেষণা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে পশ্চাৎপদ চিনা নারীদের জন্য চিনা পার্টিতে সরকারিভাবে বিবাহ সংস্কার, স্বামী নির্বাচন, নারীদের তালাক দেয়ার আইন গৃহীত হয়।
১৯৬০-এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত তিনি চিনা শিল্পকলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রতিক্রিয়াশীল শিল্পকলাতে তিনি আমূল বিপ্লবী রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এই দশ বছর মাও-এর নেতৃত্বে পরিচালিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তিনি ছিলেন মাও-এর পাশে অন্যতম বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যকার ঘাপটি মেরে থাকা বুর্জোয়া মতাদর্শধারীরা যদিওবা শর্তারোপ করেছিলো চিয়াং চিং কোনো সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না। কিন্তু চিয়াং চিং তার যোগ্যতা ও মাও-এর লাইনের আনুগত্যতায় ওই বুর্জোয়া পথগামীদের জবাব দিয়েছেন যখন তিনি ১৯৬৯ ও ১৯৭৩ সালে নবম ও দশম কংগ্রেসে পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন।
তাঁকে ১৯৬৬ সালে সেন্ট্রাল কালচারাল রিভলিউশন গ্রুপের ডেপুটি ডিরেক্টর নিযুক্ত করা হয় এবং সেই বছরের গ্রীষ্মে একটি গুরুতর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন। ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে নবম পার্টি কংগ্রেসে, তাকে পলিটব্যুরো হিসেবে উন্নীত করা হয়। তারপর তিনি ঝাং চুনকিয়াও, ইয়াও ওয়েনউয়ুন এবং ওয়াং হংওয়েন, যারা পরে চার মহাবিপ্লবী’ নামে পরিচিত হন, তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক কাজের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি মাও এর গত বছরগুলির সময় চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বিতর্কিত চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম ছিলেন।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের যুগে, মাও সেতুং ছাত্র ও যুবক যারা রেড গার্ডসের সদস্য ছিলো তাঁদেরকে দলের সংশোধনবাদীদের উপর আক্রমণ করতে অনুপ্রাণিত করেন। মাও তাদের বলেছিলেনযে, বিপ্লব বিপদের মধ্যে রয়েছে এবং তারা চীনে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির উত্থান বন্ধ করতে পারে। তিনি যুক্তি দেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নে খ্রুষচেভের মাধ্যমে যা ঘটেছে, চীনাও তা ঘটতে চলেছে।
এই সময়ে, চিয়াং আন্দোলনে একটি ক্রমবর্ধমান সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। তিনি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পার্টি এবং সরকারী কার্যকলাপে অংশ নেন। তিনি একটি বিপ্লবী মাও সেতুং এবং চার বিপ্লবীর দ্বারা কাজে সমর্থন ও সাফল্য পান। যদিও সেন্ট্রাল কালচারাল রিভলিউশন গ্রুপের একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন তিনি, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চীনা রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় মূলত ব্যস্ত ছিলেন। [১]
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রাথমিক ঝড় শেষ হয়ে গিয়েছিল যখন লিউ শাওকি ১৯৬৮ সালের ১৩ অক্টোবর তার সমস্ত পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। এরপর লিন বিয়াও হয়েছিলেন মাও মনোনীত উত্তরাধিকারী। চেয়ারম্যান মাও তখন থেকেই চার বিপ্লবীর সমর্থন করেছেন; তারা হলেনঃ চিয়াং চিং, ওয়াং হংওয়েন, ইয়াও ওয়েনউয়ান এবং ঝাং চুনকিয়াও। ১৯৭৩ সালের দশম পার্টি কংগ্রেসের পর এই চারজন বিপ্লবী র্যাডিকেল পলিটব্যুরোতে শক্তিশালী অবস্থান দখল করেন।
চিয়াং চিং চীনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৬৫ সালে পিকিং-এর মেয়র পেং চেং ২৩টি নিবন্ধ প্রকাশ বন্ধ করে দিলে মাও সেতুংয়ের নির্দেশে চিয়াং চিং, চ্যাং চুন চিয়াও ও ইয়াও ওয়েন উয়ান-এর উদ্যোগে লিখিত প্রবন্ধটি সাংহাই থেকে প্রকাশিত হয়। এই ঘটনার আগে পিকিং-এর মেয়র পেং চেং নতুন অপেরা লেকসাইড ভিলেজ-এর পিকিংয়ে প্রদর্শন বন্ধ করে দিলে চিয়াং চিং সেটিকে সাংহাইতে প্রদর্শন করেন।[২]
১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মাও সেতুং-এর মৃত্যুর পর মাও সেতুং-এর চিন্তাধারাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা ও অব্যাহতভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার তত্ত্ব শক্ত হাতে তুলে ধরলে এক মাসের মাথায় অক্টোবরে চিনা জনগণ ও বিশ্ববিপ্লবের শত্রু, মাও-এর আদর্শ বর্জনকারী তেং-হুয়া চক্র ক্যু-দেতা করে চিনা পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে। তারা চিয়াং চিংসহ সাংস্কৃতিক বিপ্লবে মাও-এর প্রধান চার সহযোগী নেতৃত্বকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে বন্দি করে। এই ভণ্ডরা ১৯৭৬ সালের তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারের দাঙ্গায় নগ্নভাবে উসকানি দিয়েছিলো। তারাই আবার এই দাঙ্গার জন্য চিয়াং চিং-কে অভিযুক্ত করে।
সংশোধনবাদী চক্র মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পতাকা বহনকারী মহান নেত্রী চিয়াং চিং-কে কুচক্রী আখ্যা দিয়ে মাও-এর লাইন তুলে ধরার নামে মাও-এর লাইনের প্রতি এক সর্বব্যাপী আক্রমণ চালায়। ১৯৮০-৮১ সালব্যাপী এক প্রহসনমূলক বিচার চলে। তেং চক্র আদালতে তার দোষ স্বীকার করতে বললে চিয়াং চিং বলেন, আদালতে আমি যদি কিছু স্বীকার করি তাহলে আমি বলবো ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছর সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করেছি এবং তা মাও-এর নেতৃত্বেই। আমি যা করেছি মাও তা সমর্থন করেছেন। প্রসিকিউটর চিয়াং চিং-এর মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করলে চিয়াং চিং দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, চেয়ারম্যান মাও একজন সেরা নারী কমরেডের মাঝে পাঁচটি গুণের সমাবেশ দেখতে চাইতেন _ ক. পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ভয়ে কখনো ভীত হয়ো না; খ. যে পদে অধিষ্ঠিত হয়েছো সেখান থেকে চ্যুত হওয়ার ভয় পেয়ো না; গ. বিবাহ বিচ্ছেদকে ভয় পেয়ো না; ঘ. কারারুদ্ধ হতে হলেও ভয় পেয়ো না; ঙ. ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হলেও তা হাসিমুখে বরণ করে নিও। মহান মাও-এর এই পাঁচটি নির্দেশের চারটি আমি ইতিমধ্যেই পালন করেছি। পঞ্চমটি বরণ করার জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই আছি। তিনি তেং-হুয়া চক্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন_ তোমাদের সাহস থাকলে তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারে দশ লক্ষ জনগণের সামনে আমাকে ফাঁসি দাও।
দুই বছরেরও অধিক সময় বিচার চলার পর ১৯৮১ সালে বিচারে চিয়াং চিং-কে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৮৩ সালে সাজা কমিয়ে সেটিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়। ১৯৯০ সালে চিনা জনগণের শত্রু তেং চক্র প্রচার দেয় যে, চিয়াং চিং আত্মহত্যা করেছেন। তেং কুচক্রীদের এই মিথ্যা প্রচারে বিশ্বের মাওবাদী পার্টি ও সংগঠনগুলো চিয়াং চিং-কে বন্দি অবস্থায় হত্যার প্রতিবাদ জানায় এবং সংশোধনবাদী গণশত্রু তেং চক্রের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানায়। বিশ্বের সাম্যবাদী বিপ্লবের ইতিহাসে এই নেত্রীর নাম লাল আলোয় লেখা থাকবে।[৩]
তথ্যসূত্র ও টিকাঃ
১. Stefan R. Landsberger (2008). Madame Mao: Sharing Power with the Chairman]
২. সমীরণ মজুমদার, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, র্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা-১৭৯
৩. এই লেখাটির অধিকাংশ তথ্যই বিপ্লবী নারীমুক্তির মুখপত্র নারীমুক্তি’র প্রথম সংখ্যা ফেব্রুয়ারি, ২০০১ থেকে নেয়া হয়েছে।
রচনাকাল ১৫ অক্টোবর, ২০১৩
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।