মিখাইল বাকুনিন একজন নৈরাজ্যবাদী রুশ বিপ্লবী

মিখাইল আলেকজান্দ্রোভিচ বাকুনিন (ইংরেজি: Mikhail Alexandrovich Bakunin) ছিলেন (১৮১৪-১৮৭৬) রাশিয়ার এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। তার চিন্তার ভেতরে ছিলো একজন পেটিবুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত চরিত্রের রুশ বিপ্লবীপনা। নৈরাজ্যবাদ বা এ্যানার্কিজম মতবাদের প্রচারকারী হিসাবেই বাকুনিন বিখ্যাত হয়েছিলেন।

বাকুনিনের মতাদর্শে বিভিন্ন দার্শনিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাবিদদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। গোড়ার দিকে তিনি জার্মান দার্শনিক ফিকটের চিন্তাধারায দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে হেগেলের দর্শন তাঁকে প্রভাবিত করে। মার্কসবাদের মতে বলা হয় যে, বাকুনিন হেগেলের দর্শনের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার পরিবর্তে তার ভাববাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন।

সমাজরাষ্ট্র সম্পর্কে বাকুনিনের মতবাদ ছিলো এই রকমের যে মানুষ মূলত দুটি যন্ত্র দ্বারা নিষ্পেষিত হচ্ছে —  একটি রাষ্ট্রযন্ত্র অপরটি ধর্মযন্ত্র বা অলীক বিধাতার দণ্ড। রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার থেকে মুক্তির আশ্বাসে মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের আশ্রয় নেয়। আসলে ধর্ম এবং রাষ্ট্র যুক্তভাবেই মানুষকে শোষণ করে। মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে এই উভয় যন্ত্রকে ধ্বংস করা। বাকুনিনের ধ্বংসমূলক এ মতের পরিপূরক কোনো গঠনমূলক মত ছিল না। তার মতে রাষ্ট্রযন্ত্র বাদে মানুষ স্বাভাবিকভাবে যূথবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করতে সক্ষম। সেই সমাজে কারুর কোনো শাসন বা খবরদারী থাকবে না। বাকুনিনের মতের একটি বিপ্লবাত্মক দিক আছে। কার্ল মার্কসও প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার উচ্ছেদের কথা প্রচার করেছেন। কিন্তু প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন মার্কসবাদের অপর অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনার ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের কারণে মাকর্স বাকুনিনকে প্রথম আন্তর্জাতিকের সদস্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মার্কসবাদী চিন্তার বিরোধিতার ফলে বাকুনিন প্রথম আন্তর্জাতিক থেকে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বহিষ্কৃত হন। মার্কস-এর সঙ্গে বাকুনিনের মতাদর্শের বিরোধের মূল কারণ ছিলো, মার্কস বাকুনিনকে নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবী বলে গণ্য করতেন।

বাকুনিন সমাজ বিপ্লবের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে যেমন কোনো গঠনমূলক মত পোষণ করতেন না, তেমনি সমাজ বিপ্লবের জন্যও কোনো সুসংবদ্ধ সংগঠন ও আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেন না। বাকুনিন কৃষক এবং ভবঘুরে সর্বহারাকে বিপ্লবের প্রধান শক্তি বলে বিবেচনা করতেন। কৃষক ও ভবঘুরে সর্বহারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করবে, এই ছিলো বাকুনিনের বিশ্বাস। সমসাময়িক সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ প্রুধোঁর মতামতের প্রভাবও বাকুনিনের মধ্যে লক্ষ করা যায়। ‘ফেডারিলিজম, সোস্যালিজম এ্যাণ্ড এ্যান্টি থিওলজিজম’ বলে লিখিত বাকুনিনের গ্রন্থে সমাজের যে পরিকল্পনা বাকুনিন প্রথমে উপস্থিত করেন, তা মূলত প্রুধোঁর নিকট থেকেই গৃহীত। তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন এবং সেটি অর্জনের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে ভিত্তি মনে করতেন। তিনি বলেছেন যে, “অর্থনৈতিক সমতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা হচ্ছে একটি ভান, একটি প্রতারণা, একটি মিথ্যা; এবং শ্রমিকগণ মিথ্যা চায় না”[১]।

আরো পড়ুন:  নৈরাজ্যবাদ অথবা সমাজতন্ত্র

বাকুনিনের জীবন ঘটনাবহুল। নিজের মতাদর্শ নিয়ে তৎকালীন বিক্ষুব্ধ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লব ও আলোড়নে একাধিকবার অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ১৮৪৮-৫০ প্রেগবিপ্লবে তাঁর অংশগ্রহণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উক্ত ঘটনার পরে রুশদেশে প্রত্যাবর্তনকালে বাকুনিনকে গ্রেপ্তার করে রুশ সরকার সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে। ১৮৬১ সালে সাইবেরিয়ার নির্বাসন থেকে পলায়ন করে জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে বাকুনিন আবার ইউরোপে উপস্থিত হন। রাশিয়ার নারোদনিক পন্থীগণ বাকুনিনের নৈরাজ্যবাদী মত দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কার্ল মার্কস ব্যতীত ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এবং লেনিনও বাকুনিনের নৈরাজ্যবাদী মতের তীব্র সমালোচনা হাজির করেন।[২]

তথ্যসূত্র:

১. মিখাইল বাকুনিন, বাকুনিন রচনাবলী, লাল সংগঠন, ১৮৭০, Modern Publishers, Indore Kraus Reprint Co. New York, 1947.

২. সরদার ফজলুল করিম, দর্শনকোষ, প্যাপিরাস, পঞ্চম সংস্করণ, জুলাই ২০০৬, পৃষ্ঠা ৭৫-৭৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!