উৎপল দত্ত বাংলার এক মহান নাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক

উৎপল দত্ত (মার্চ ২৯, ১৯২৯- আগস্ট ১৯, ১৯৯৩) একজন বাঙালি অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থীমার্কসবাদী। আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের ইতিহাসে অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যকার  হিসেবে তার স্থান সুনির্দিষ্ট।

তাঁর জন্ম বাংলাদেশের বরিশালে। পিতা গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মাতা শৈলবালা দত্ত। তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং তখন থেকেই শেকসপিয়ারের নাটকের অভিনয়ের ও নাট্যচর্চার সুত্রপাত। জেফরি কেনডাল-এর শেকসপিয়ারানা সম্প্রদায়ের সংগে ভারত পর্যটনে বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন রকমের দর্শক সমাবেশে ধ্রুপদি নাটক পরিবেশন করেন। ১৯৪৭ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে শেকসপিয়ার, বার্নাড শ, ক্লিফর্ড ওডেটস প্রমুখের নাটক ইংরেজিতে প্রযোজনা করতে করতেই সীমিত দর্শক সমাজের সীমাবদ্ধতায় বিব্রত হয়ে লিটল থিয়েটার গ্রুপ (এলটিজি)-কে বাংলা প্রযোজনার দিকে পরিচালিত করেন। সংগে সংগেই বৃহত্তর দর্শক সমাজের কাছে পৌঁছবার আত্যন্তিক আগ্রহে গণনাট্য সংঘে ও রাজনৈতিক পথ-নাটিকার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ কর্তৃক মিনার্ভা থিয়েটার অধিগ্রহণ ও নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের কর্মসূচি গ্রহণ এবং তার পরিচালনায় তারই লেখা ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘কল্লোল’ প্রভৃতি নাটকে রাজনৈতিক বোধ, আঙ্গিক প্রয়োগ নাটক ও নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁকে গ্রুপ থিয়েটার অঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হিসাবে গণ্য করা হয়।

১৯৭১ সালে পিপলস লিটল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক তার একটি বড় পদক্ষেপ। কৌতুক অভিনেতা হিসাবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। তিনি কৌতুক চলচ্চিত্র গুড্ডি, গোলমাল ও শৌখিনে অভিনয় করেছেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ এবং আগন্তুক সিনেমায় অভিনয় করেছেন ।

উৎপল দত্তের বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রয়েছে টিনের তলোয়ার, মানুষের অধিকার, মেঘ, রাইফেল, সীমান্ত, ঘুম নেই, মে দিবস, দ্বীপ, রাতের অতিথি, মধুচক্র, কল্লোল, সমাজতান্ত্রিক চাল, সমাধান ইত্যাদি।

আরো পড়ুন:  পল লাফার্গ ছিলেন বিপ্লবী মার্কসবাদী, সাহিত্য সমালোচক এবং রাজনৈতিক লেখক

উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে আবার পাওয়া যায় শ্রেণিচেতনা, ইতিহাস চেতনা ও মধ্যবিত্ত চেতনা। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে যেমন পাওয়া যায় শ্রেণি সচেতনতা, তেমনি ‘টোটা, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’, ‘দিল্লী চলো’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ প্রভৃতি নাটকের ইতিহাস চেতনা, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারী ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকের মধ্যবিত্ত চেতনা তাঁর নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা।

উৎপল দত্ত যেহেতু মার্কসবাদকে জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তাই তাঁর শিল্প সাহিত্য বিবেচনা করতে হবে মার্কসবাদের কষ্টিপাথরে। শিল্প-সাহিত্য সমালোচনা প্রসঙ্গে মার্কসবাদের অন্যতম পুরোধা তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা, মহান বিপ্লবী মাও সে তুং-এর ইয়েনান ভাষণের সেই অভ্রান্ত সিদ্ধান্ত আমরা পড়ে দেখলে দেখব, উৎপল দত্ত প্রলেতারিয় বিপ্লবী রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার জন্যই কলম ধরেছেন। মাও সেতুং লিখেছেন,

‘শিল্প ও সাহিত্য সমালোচনার দুটি মানদণ্ড আছেঃ একটি রাজনৈতিক অপরটি শৈল্পিক। …শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রত্যেক শ্রেণীর নিজস্ব রাজনৈতিক ও শৈল্পিক মানদণ্ড আছে। কিন্তু সমস্ত শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সমস্ত শ্রেণীই সর্বদা শৈল্পিক মানদণ্ডের চেয়ে রাজনৈতিক মানদণ্ডকে স্থান দিয়ে থাকে।… … আমরা দাবি করব রাজনীতি ও শিল্পকলার ঐক্য, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের ঐক্য, বিপ্লবী রাজনৈতিক বিষয়বস্তু এবং যত উচ্চমানের সম্ভব উৎকৃষ্ট শিল্পগুণান্বিত আঙ্গিকের ঐক্য।’[১]

মাও সেতুংয়ের কথাটিকে উপলব্ধটিতে রেখে যেন তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যে কোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগাণ্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়’।[২] তাঁর কাছে ‘থিয়েটার পাগলাগারদ নয়, প্রায় সামরিক ব্যারাক।’

উৎপল দত্ত পুঁজিবাদসমাজতন্ত্র সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি পুঁজিবাদি মানুষ ও পুঁজিবাদ সম্পর্কে বলেছেন, মানুষ সম্পর্কে তাঁর গভীরতম ধারনা তাঁর নাটকগুলোকে সফল করেছে। তাঁর মানুষ সংক্রান্ত চেতনা শ্রেণিসমাজের বাস্তব চেতনাকে ধারন করেই। ‘শেকসপিয়ারের সমাজ চেতনা’ গ্রন্থে তিনি দাস-সামন্ত-পুঁজিবাদী সমাজের মানুষের বিশ্লেষণ হাজির করেছেন যা পাঠকদেরকে বাস্তব মানুষ বুঝতে সাহায্য করে।

“নিজেকে নিয়ে মেতে আছে বলেই পুঁজিবাদি সমাজে মানুষ আর মনুষ্যপদবাচ্য থাকে না; তার মনুষ্যত্বই হয়ে যায় পঙ্গু ও বিকৃত।”[৩]

“নির্ভেজাল ভোগবৃত্তির উপাসনাই আজ পুঁজিবাদের একমাত্র ধর্ম।”[৪]  

উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসেরও এক বিশ্লেষক। উনিশ শতকের বঙ্গীয় সামন্তশ্রেণির বিরুদ্ধে মধুসূদনের বিদ্রোহকে তিনি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, মধুসূদন শেষ পর্যন্ত উনিশ শতকের ঘুণধরা ও বিকলাঙ্গ সমাজের বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ।[৫] 

আরো পড়ুন:  বের্টোল্ট ব্রেশট আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় কবি

১৯৯৩ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র ও টিকা:  

১. মাও সেতুং, সাহিত্য ও শিল্পকলা সম্পর্কে ইয়েনানের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণ, মে,১৯৪২।

২. উৎপল দত্ত, উদ্ধৃত: অশোককুমার মুখোপাধ্যায়, “বহুমুখী প্রতিভার পরিশ্রমী জীবনী”, পরবাস-৪৮, মে, ২০১১, https://www.parabaas.com/PB48/LEKHA/brAshoke48.shtml

৩. উৎপল দত্ত; প্রতিবিপ্লব; এম সি সরকার এন্ড সন্স প্রা. লি.; কলকাতা; দ্বিতীয় সংস্করণ; ভাদ্র ১৪০০; পৃষ্ঠা-১৪।

৪. উৎপল দত্ত; পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১৩।

৫. অরূপ মুখোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত জীবন ও সৃষ্টি; ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া; প্রথম প্রকাশ ২০১০; পৃষ্ঠা ২৪৭।   

রচনাকাল: ২৮ মার্চ, ২০১৩

Leave a Comment

error: Content is protected !!