কার্ল মার্কস রচিত পুঁজি গ্রন্থ প্রসঙ্গে একটি বিস্তারিত আলোচনা

পুঁজি বা ডাস কাপিটাল (জার্মান: Das Kapital; ইংরেজি: Capital; বাংলা: পুঁজি) কার্ল মার্কসের লেখা পুঁজিবাদের সমালোচনামূলক একটি বই। এই বই সমাজ প্রগতি সম্বন্ধে তৎকালীন প্রচলিত অভিমতে বিপ্লব ঘটিয়েছিল এবং অর্থনীতিকে এক বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তির উপরে স্থাপন করেছিল।

প্রথম খণ্ডে মার্কস পুঁজির গঠন অর্থাৎ পুঁজি কিভাবে সৃষ্টি হয়; দ্বিতীয় খণ্ডে পুঁজির সঞ্চারণ বা সারকুলেশন এবং তৃতীয় খণ্ডে তিনি সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করেন। চতুর্থ খণ্ডে স্থান পেয়েছে বাড়তি বা উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব। মানুষের সভ্যতার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে মার্কস পুঁজিবাদকে একটি বিশেষ পর্যায় বলে চিহ্নিত করে তার সুবিস্তারিত বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি পুঁজিবাদের উৎপত্তি বিকাশ এবং তার পরিণাম বা ধ্বংসের বিধানকে উদঘাটন করেন।[১] 

পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো, তার দুই বিপরীত প্রধান শ্রেণি প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়ার অভ্যন্তরীণ বৈরিতা, পুঁজিপতিদের স্বার্থ সুরক্ষাকারী বুর্জোয়া রাজনৈতিক উপরিকাঠামো, মুক্তি ও সমতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধ্যানধারণা এবং বুর্জোয়া পরিবার ও দৈনন্দিন অন্যান্য দিক সমেত এক জীবন্ত সামাজিক অর্থনৈতিক গঠনরূপ হিসেবে পুঁজিবাদ সম্বন্ধীয় এক সামগ্রিক অনুসন্ধান চালান কার্ল মার্কস তাঁর এই সত্যিকারের বিশ্বকোষসুলভ মহাগ্রন্থে।[২]

‘পুঁজি’ বইখানির ভূমিকায় মার্কস লিখেছেন, ‘আধুনিক সমাজের’, অর্থাৎ পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজের ‘গতিধারার অর্থনৈতিক নিয়ম প্রকাশ করাই এই গ্রন্থের চূড়ান্ত লক্ষ্য’।[৩]  ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট একটি বিশেষ সমাজের উৎপাদন-সম্পর্কের উদ্ভব, বিকাশ ও পতনের অনুসন্ধান — এই হলো মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদের বিষয়বস্তু। [৪]

দার্শনিক ও ঐতিহাসিক রচনা হওয়ার সাথে সাথে এই গ্রন্থ মুখ্যত অর্থনৈতিক তত্ত্ব নিরূপণের দিকে, পুঁজিবাদী বিকাশের অর্থনৈতিক নিয়ম—উদ্বৃত্ত-মূল্যের (theory of surplus value) নিয়ম আবিষ্কারের দিকে নিয়োজিত হয়েছিল। উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বটির আবিস্কার গোটা অর্থশাস্ত্রের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনে দিল এবং দেখিয়ে দিল যে এটিই গোটা পুঁজিবাদী উৎপাদনের মর্মকথার চাবিকাঠি। এই বিষয়ে এঙ্গেলস লিখেছেন,

“উদ্বৃত্ত মূল্য পদার্থটি কী তা জানার জন্যে মার্কসকে প্রথমে জানতে হয়েছে মূল্য পদার্থটি কী। মূল্য-সংক্রান্ত খোদ রিকার্ডোর তত্ত্বটিকেই এর জন্যে তাঁকে সমালোচনার অধীনে আনতে হয়েছে। এইভাবে মার্কস শ্রম বস্তুটির পর্যালোচনা করেছেন তার মূল্য উৎপাদনকারী বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে, এবং তিনিই প্রথম দৃঢ়ভাবে এই মতের প্রতিষ্ঠা করলেন: যে কোন ধরনের শ্রম মূল্য উৎপাদন করে ও কেন ও কীভাবে তা উৎপাদন করে এবং এই সিদ্ধান্তে এলেন যে মূল্য বস্তুটি আসলে এই ধরনের ঘনীভূত শ্রম ছাড়া অন্য কিছুই নয়। উল্লেখ্য যে মার্কসের আগে রডবের্টুস তাঁর জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত এই শেষোক্ত ব্যাপারটি ধরতেই পারেন নি। মার্কস অতঃপর পরীক্ষা করে দেখলেন পণ্য সম্ভারের সঙ্গে অর্থের সম্পর্কটি এবং দেখলেন কীভাবে ও কেমন করে মূল্য-সম্পর্কিত তাদের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্টের দৌলতে পণ্যসম্ভার ও পণ্য-বিনিময় পণ্য ও অর্থের বৈপরীতোর জন্ম দিতে বাধ্য। এই ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মার্কসের অর্থ-সংক্রান্ত তত্ত্বটি এ-বিষয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ, ও বর্তমানে খোলাখুলি স্বীকার না-করা, সত্ত্বেও, সাধারণভাবে সর্বজনগৃহীত তত্ত্ব।

অর্থের পুঁজিতে রূপান্তরসাধন নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে মার্কস প্রমাণ করলেন যে এই রূপান্তরের ভিত্তি হলো শ্রমশক্তির ক্রয় ও বিক্রয়। সাধারণভাবে শ্রমের জায়গায় শ্রমশক্তি, বা তার মূল্য-উৎপাদনকারী বৈশিষ্ট্যটিকে বদলে নেয়ার ফলে এক কলমের আঁচড়ে তিনি এমন একটি সমস্যার সমাধান করলেন যে-সমস্যার ডুবোপাহাড়ের ধাক্কায় রিকার্ডীয় মতবাদের জাহাজের ভরাডুবি হয়ে গিয়েছিলো। সে-সমস্যা হলো, শ্রমের দ্বারা রিকার্ডীয় মূল্য-নিরূপণ সংক্রান্ত তত্ত্বের সাহায্যে পুঁজি ও শ্রমের পারস্পরিক বিনিময়ের সামঞ্জস্যবিধানের অসম্ভাব্যতা। ‘বদ্ধ’ ও ‘চল’ পুঁজির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করার ফলে মার্কসই প্রথম একেবারে খুঁটিনাটির বিশদীকরণ সহ উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ার সত্যিকার পথের রূপরেখা নিরূপণে সমর্থ হলেন এবং ফলত সমর্থ হলেন তার ব্যাখা যোগানোতেও! প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে তাঁর পূর্বসূরিদের কেউই এ-কাজে সমর্থ হন নি। এইভাবে মার্কস খোদ পুঁজির মধ্যেই এমন এক তারতম্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন, যে ব্যাপারে তাঁর আগে না-রডবের্টুস না-বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রীরা কেউই কোনো কুলকিনারা করে উঠতে পারেন নি। অথচ আলোচ্য এই ব্যাপারটিই সবচেয়ে জটিল অর্থনৈতিক সমস্যাবলী সমাধানের চাবিকাঠিটি যুগিয়ে দিচ্ছে — ফের একবার যার অত্যন্ত লক্ষণীয় প্রমাণ মিলেছে ‘পুঁজি’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে এবং আমরা দেখাব যে এর আরও বেশি উল্লেখ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ওই গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডে; মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্যের আরও বিশ্লেষণ করে তার দুটি ধরন আবিস্কার করেছেন, যথা অনপেক্ষ ও আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্য; এবং পুঁজিবাদী উৎপাদনের ঐতিহাসিক বিকাশের ক্ষেত্রে ওই দুই ধরনের উদ্বৃত্ত মূল্য-যে বিভিন্ন, অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে তা দেখিয়েছেন। উদ্বৃত্ত মূল্য নিরূপণের ভিত্তিতে মার্কস বিকশিত করে তুলেছেন মজুরি সম্পর্কে এ-পর্যন্ত আমরা যা পেয়েছি তার মধ্যে এই প্রথম যুক্তিসম্মত একটি তত্ত্ব এবং এই প্রথম তিনি নির্ধারণ করলেন পুঁজিবাদী সঞ্চয়ের ইতিহাসের মৌল বৈশিষ্ট্যগুলি ও তার ঐতিহাসিক প্রবণতার একটি রূপরেখা।[৫]

পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে মার্কস পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদন প্রণালীর বিশ্লেষণ করেছেন। পুঁজিবাদী সমাজে পণ্য উৎপাদনেরই প্রাধান্য। মার্কসের বিশ্লেষণ তাই শুরু হয়েছে পণ্যের বিশ্লেষণ দিয়ে।[৬]  এই সমাজে বাজারে বিক্রয়ার্থ পণ্যদ্রব্যের দুটি চেহারা দেখতে পাওয়া যায়। একটিতে তার ব্যবহারিক মূল্য প্রকাশ পায়, অপরটিতে বিনিময় মূল্য। বিক্রয়যোগ্য পণ্যের অতুল সঞ্চয় থেকে পুঁজিবাদী সমাজে সম্পদের উদ্ভব—এরই বিশ্লেষণ ও সামাজিক সম্পর্ক পুঁজি-এর প্রথম খণ্ডের প্রতিপাদ্য। পণ্যের সামাজিক সম্পর্কের স্বরূপ — বিশেষ করে একাধিক পণ্যের বিনিময়যোগ্য তুলনাত্মক সম্পর্ক যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশেষ ব্যবস্থার ফলেই গড়ে ওঠে। — তারই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানতে পারি যে পুঁজিবাদী সমাজে বিক্রয়যোগ্য পণ্য আসলে উদ্ধৃত্ত মূল্যের বস্তুগত রূপ বা অর্থকর রূপ (যেখানে মূল্যের জন্য অর্থও বিশেষরূপে পণ্য হিসেবে পরিগণিত), সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের উৎপাদনকারী শ্রম ও পণ্যরূপে পর্যবসিত হয়। উৎপাদনকারী শ্রম ও উদ্ধৃত্ত মূল্যের সহযোগে বিনিময়ের মাধ্যমে যে মুনাফা বা বাড়তি আয় ঘটে তার ক্রমবিনিয়োগে ক্রমশ বর্ধিত হারে মুনাফারও স্ফীতি ঘটে। একটা স্পাইরাল ধর্মী চক্রাবর্তনে যথা, শ্রম-উৎপাদন-বাড়তি মুনাফা-বিনিয়োগ-শ্রম-উৎপাদন এইভাবে বর্ধিত পুঁজির সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ ব্যবস্থার মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনীতির কার্যক্রম চলে।[৭]

আরো পড়ুন:  কবিতা জানাতে চায়

পুঁজি-এর প্রথম ভাগে সামন্তবাদী অর্থনীতি থেকে পুঁজিবাদের উদ্ভব ও প্রগতির ইতিহাস বর্ণিত আছে। সামন্তবাদী আর্থিক ব্যবস্থার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের বদল ও নতুন আর্থিক ব্যবস্থার প্রচলনে নতুন সম্পর্কের জন্মের কথাও আমরা জানতে পারি। এই নতুন সমাজসম্পর্কের সামগ্রিক চিত্র থেকে এটাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিত্তহীন শ্রমিক শ্রেণি উদৃত্ত মূল্য উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র, আর পুঁজির মালিক উদ্ধৃত্ত আয়কে বিনিয়োগযোগ্য পুঁজিতে পরিণত করার যন্ত্রস্বরূপ। [৮]

কিন্তু এই অমানবিক সম্পর্কের অস্তিত্ব পুঁজিবাদী সমাজে চিরস্থায়ী নয় — শ্রমিক শ্রেণী ইতিহাসের হাতিয়ার হিসেবে এই অমানবিক সমাজসম্পর্কের বদল ঘটাবে। সমাজতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থার পরিবেশে এই বদল সম্ভব। সমাজদেহের এই মৌল পরিবর্তনের যুক্তিগ্রাহ্য প্রক্রিয়া মার্কসই বিবৃত করেছেন। অবশ্য মার্কসের আগে বিভিন্ন কল্পলৌকিক মতবাদ আশ্রয় করে সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন মতধারা গড়ে উঠেছিল। পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ড সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে সমাজবিজ্ঞানের যুক্তিগ্রাহ্য প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠা দেয়।[৯]

পুঁজি বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের উপনাম পুঁজির সঞ্চালন প্রক্রিয়া-দি প্রসেস অফ সার্কুলেশন অফ ক্যাপিটাল। এ ক্ষেত্রে মার্কস পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পুঁজির চক্রবৎ গতি বা আবর্তন, নিয়োজিত পুঁজির পণ্যে রূপান্তর ও পরিশেষে বাজার পদ্ধতির মধ্যে বিনিময় ব্যবস্থায় বিভিন্ন পণ্যে উৎপাদন ও মূল্যমানের ভারসাম্যের অবস্থায় সরল পুনরুৎপাদন পদ্ধতির প্রচলন ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। অর্থনৈতিক সংকটের প্রশ্নও দ্বিতীয় খণ্ডে আলোচিত। পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্থায়িত্ব নেই। ভারসাম্যের অবস্থা থেকে তার নিয়মিত বিচ্যূতি, কেননা ক্রমাগত উদৃত্ত মূল্য আকর্ষণের পরিণামে উৎপাদনশক্তি একসময়ে অব্যবহার্য হয়ে পড়ে, তখনই অর্থনৈতিক সংকটের অবস্থা সৃষ্টি হয়। আর সব সংকটই একটি মাত্র পরিণতির প্রতি দিকনির্দেশ করে — পুঁজিবাদের যা নিয়তি।[১০]

পুঁজি বইয়ের তৃতীয় খণ্ডের উপ-নাম পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্র (The Process of capitalist production as a whole)। এখানে মার্কস প্রসঙ্গত বিশেষ বিশেষ মূল্যমানের প্রশ্ন, পুঁজির মুনাফার হার ও উদ্ধৃত্ত মূল্যের বিভাজন থেকে প্রাপ্ত মুনাফার কথা তুলেছেন এবং সুদ ও খাজনার প্রশ্নে আগের দুখণ্ডের আলোচনা থেকে আরও বিস্তৃত বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় এসেছেন। মার্কস দেখিয়েছেন, পণ্যোৎপাদনে পুঁজির মালিকের ব্যয়ের পরিমাণ ও পণ্যের যথার্থ উৎপাদন ব্যয় সমান নয়। প্রথম খণ্ডে আলোচনার প্রাধান্য ছিল উদৃত্ত মূল্যের হারের উপর — মার্কস যার গাণিতিক রূপ দিয়েছেন উদ্ধৃত্ত মূল্য ও মজুরি ব্যয়ের অনুপাত হিসেবে। তৃতীয় খণ্ডে এই প্রাধান্য এসেছে মুনাফার হারের উপর।[১১] 

আরো পড়ুন:  পুঁজিবাদের বিকাশের বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থের নাম ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’

পুঁজি গ্রন্থের তিনটি খণ্ডের প্রতিটি, সেগুলোর প্রতিটি অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ হলো পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের অন্তঃসার সম্বন্ধে, ঐতিহাসিকভাবে সেই সম্পর্কের ক্ষণস্থায়ী চরিত্র সম্বন্ধে বোধের ক্ষেত্রে সরল থেকে জটিলে, নিম্নতর থেকে উচ্চতরে আরোহণের একটি পর্যায়। মার্কস পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের গোটা ব্যবস্থাটার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছেন এবং পুঁজিবাদকে সর্বপ্রকারে পরীক্ষা করেছেন একটা জীবন্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক গঠনরূপ হিসেবে।[১২]

মার্কস-এর ‘পুঁজি’ কেবল আর্থনীতিক বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ নয়। মার্কস-এর সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টি অর্থাৎ তাঁর দর্শন এই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত মার্কসবাদ তথা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মূল গ্রন্থ হচ্ছে ‘পুঁজি’। মার্কস তার দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রয়োগের ভিত্তিতে মানুষের সামাজিক আর্থনীতিক বিকাশকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদ কোনো অনড় এবং স্থায়ী অস্তিত্ব নয়। পুঁজিবাদ একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া। এই আর্থনীতিক প্রক্রিয়া এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক কাঠামো যেমন আদিতে ছির না, তেমনি ভবিষ্যতেও এর পরিবর্তন বা রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন অর্থনীতিক উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সামাজিক-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে সেই গুণগত রূপান্তরের মুহুর্ত যে অনিবার্যবাবে অগ্রসর হয়ে আসছে তা মার্কস সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন। অন্যান্য ব্যবস্থায় যেমন, পুঁজিবাদের অভ্যন্তরেও তেমনি পরিবর্তনের মূল কারণ তার আভ্যন্তরিক বিরোধ। এই বিরোধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্মের পর থেকে উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এবং উৎপাদন সম্পর্কের অনিবার্য যৌথ বা সমষ্টিগত রূপের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এবং সে বিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বিস্ফোরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার একমাত্র পরিণাম হচ্ছে ‘এক্সপ্রোপ্রিয়েটিং দি এক্সপ্রোপ্রিয়েটরস’ বা ‘উচ্ছেদকের উচ্ছেদ’ অর্থাৎ উপাদনের উপায়ের উপর সমষ্টিগত মালিকানার প্রতিষ্ঠা। পরির্তনের এই ক্রম ব্যাখ্যায় মার্কস এই বিরোধের ক্রম বিকাশের প্রতিটি স্তর, সে স্তরের বৈশিষ্ট্য, তার সংকটের বিশেষ সমাধানের ভিত্তিতে নতুনতর স্তরে আগমন বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন এবং পরিশেষে এই বিকাশের বিধানের উল্লেখ করে বলেছেন ‘একটি বিশেষ উৎপাদন-ব্যবস্থায়ে যে বিরোধ অন্তর্নিহিত থাকে তার ঐতিহাসিক বিকাশের মাধ্যমেই মাত্র সেই উৎপাদন-ব্যবস্থার উচ্ছেদ এবং তার স্থানে নতুন উৎপাদন-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা সম্ভব’।[১৩]

আরো পড়ুন:  মার্কস এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারের সূচিপত্র

প্রথম যে বিদেশি ভাষায় ‘পুঁজি’ অনূদিত হয়েছিল, ১৮৭২ সালে, তা ছিল রুশ ভাষা। মার্কসবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব রাশিয়ায় উর্বর জমির উপর পড়েছিল, দ্রুত শিকড় চালিয়ে দিয়েছিল গভীরে এবং অঙ্কুরিত হয়ে পরিণত হয়েছিল এক মহাবৃক্ষে।[১৪]

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৯৮-৯৯।

২. স. ইলিন ও আ. মাতিলেভ; অর্থশাস্ত্র কী, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৮৮; পৃষ্ঠা- ১১৭-১৮।

৩. কার্ল মার্কস, পুঁজি প্রথম খণ্ড, প্রথম অংশ, প্রথম জার্মান সংস্করণের পূর্বাভাষ, ২৫ জুলাই, ১৮৬৭, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ২১

৪. ভি আই লেনিন, মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদ, জুলাই-নভেম্বর, ১৯১৪, মার্কস এঙ্গেলস মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ২০

৫. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, ৫ মে, ১৮৮৫, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, খণ্ড ছয়, ১২ খণ্ডে, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৮১, পৃষ্ঠা ১২৫-২৬।

৬. ভি আই লেনিন, মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদ, জুলাই-নভেম্বর, ১৯১৪, মার্কস এঙ্গেলস মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ২০

৭-১১. মুরারী ঘোষ, কার্ল হাইনরিশ মার্কস, নির্বাচিত এক্ষণ, প্রথম খণ্ড, সম্পাদনা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশ্রুকুমার শিকদার, সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮ পৃষ্ঠা ২৮৮-২৮৯।

১২. স. ইলিন ও আ. মাতিলেভ; অর্থশাস্ত্র কী, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৮৮; পৃষ্ঠা- ৮৩।

১৩. সরদার ফজলুল করিম, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৮-৯৯।

১৪. স. ইলিন ও আ. মাতিলেভ; অর্থশাস্ত্র কী, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৮৮; পৃষ্ঠা- ১২০।

রচনাকাল ২ আগস্ট, ২০১৪

Leave a Comment

error: Content is protected !!