ইয়োসেফ ব্লক সমীপে এঙ্গেলস

লন্ডন ২১-২২ সেপ্টেম্বর ১৮৯০[১]

ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা অনুসারে বাস্তব জীবনের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনই হচ্ছে ইতিহাসে শেষ পর্যন্ত নির্ধারক বস্তু। এর বেশি কিছু মার্কস বা আমি কখনো বলিনি। অতএব, কেউ যদি তাকে বিকৃত করে এই দাঁড় করায় যে, অর্থনৈতিক ব্যাপারই হচ্ছে একমাত্র নির্ধারক বস্তু, তাহলে সে প্রতিপাদ্যটিকে একটি অর্থহীন, অমূর্ত, নির্বোধ উক্তিতে পরিণত করে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি হলো ভিত্তি, কিন্তু উপরিকাঠামোর বিভিন্ন বস্তু যেমন, শ্রেণিসংগ্রামের রাজনৈতিক রূপগুলি এবং তার ফলাফল: সাফল্যমণ্ডিত সংগ্রামের পর বিজয়ী শ্রেণি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সংবিধান ইত্যাদি, বিচার ব্যবস্থা, এমনকি যোগদানকারীদের মস্তিষ্কে এই সমস্ত বাস্তব সংগ্রামের প্রতিফলন, রাজনৈতিক, আইনগত, দার্শনিক তত্ত্বাবলী, ধর্মীয় মতামত এবং ক্রমে সেগুলির আপ্তবাক্যে পরিণতি, এসবও ঐতিহাসিক সংগ্রামগুলির গতিকে প্রভাবিত করে এবং বহুক্ষেত্রে তাদের রূপ নির্ধারণে প্রধান হয়ে ওঠে। এদের সকলের একটি পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া রয়েছে যেখানে অসংখ্য আকস্মিকতার মধ্যে (অর্থাৎ এমন সব বস্তু ও ঘটনার মধ্যে, যাদের আন্তঃসম্পর্ক এত ক্ষীণ কিংবা এত প্রমাণাসাধ্য যে তা অবিদ্যমান অথবা উপেক্ষণীয় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে) অর্থনৈতিক আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আবশ্যিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। অন্যথায় পছন্দ মতো ইতিহাসের যে কোনো আমল সম্পর্কে তত্ত্ব প্রয়োগ করা প্রথম ডিগ্রির সরল সমীকরণের সমাধানের চেয়েও সহজ হত।

আমরা নিজেরাই আমাদের ইতিহাস সৃষ্টি করি, কিন্তু সৃষ্টি করি সর্বাগ্রে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট কতকগুলি পূর্বস্থিতি ও অবস্থার মধ্যে। এদের মধ্যে অর্থনৈতিক পূর্বস্থিতি ও অবস্থাই শেষ পর্যন্ত নির্ধারক হয়। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি, এমনকি মানব মনকে আচ্ছন্ন করে থাকে যে ঐতিহ্য, তাও একটা ভূমিকা গ্রহণ করে, যদিও সে ভূমিকা নির্ধারক নয়। প্রুশীয় রাষ্ট্রও ঐতিহাসিক ও শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক কারণ থেকেই উদ্ভুত হয়ে বিকশিত হয়েছিলো। কিন্তু খামোকা পাণ্ডিত্য জাহির করার ইচ্ছা না থাকলে একথা কিছুতেই বলা যায় না যে, উত্তর জার্মানির বহু ছোট ছোট রাষ্ট্রের মধ্যে ব্রান্দেনবুর্গই যে উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের অর্থনীতিগত, ভাষাগত এবং এমনকি রিফর্মেশনের পর, ধর্মগত পার্থক্যের প্রতীকরূপ একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়েছিলো তা অর্থনৈতিক প্রয়োজনের দ্বারাই বিশেষভাবে নির্ধারিত হয়েছিলো, এবং তার পেছনে আর কোনো উপাদান ছিলো না (যথা, সর্বোপরি, প্রাশিয়া দখলে থাকায় পোল্যান্ডের সঙ্গে ব্রান্দেনবুর্গের জড়িয়ে পড়া এবং কাজে কাজেই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, যা অস্ট্রীয় রাজবংশগত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায়ও চূড়ান্ত ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো)। জার্মানির অতীতের ও বর্তমানের প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র রাজ্যের অস্তিত্ব অথবা সেই উত্তর জার্মানির ব্যঞ্জনধ্বনির অভিশ্রুতির উদ্ভব যা সুদোতিক পর্বতমালা থেকে তাউনাস পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড় দ্বারা গঠিত ভৌগোলিক বিভাগপ্রাচীরকে আরও বিস্তৃত করে তুলে সারা জার্মানিব্যাপী একটি রীতিমতো ফাটল সৃষ্টি করেছিলো, নিজেকে হাস্যকর করে না তুলে অর্থনীতি দ্বারা এসবের ব্যাখ্যা করতে যাওয়া খুবই মুশকিল।

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক দল কী, কাকে বলে ও কেন প্রয়োজন

দ্বিতীয়ত, ইতিহাস এমনভাবেই সৃষ্টি হয় যাতে চূড়ান্ত ফলাফল সর্বদা বহু ব্যক্তিগত ইচ্ছার সংঘাত থেকে উদ্ভুত হয় এবং এই ইচ্ছার প্রত্যেকটি আবার জীবনের বেশ কতকগুলি বিশেষ অবস্থার দ্বারা গঠিত। এইভাবে অসংখ্য পরস্পর ছেদনকারী শক্তি রয়েছে, রয়েছে শক্তির অসংখ্য সামন্তরিক ক্ষেত্রের ধারা এবং এদেরই মধ্যে থেকেই উদ্ভুত হয় একটি সাধারণ ফল- ঐতিহাসিক ঘটনা। একে আবার এমন একক একটি শক্তির সঞ্জাত ফল বলেও ধরে নেওয়া যেতে পারে, যা সামগ্রিক হিসাবে অচেতন ও ইচ্ছাশক্তিহীনভাবে কাজ করে। কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তি যা চায় অপর প্রত্যেক ব্যক্তি তাতে বাধা দেয় এবং ফলাফল দাঁড়ায় এমন কিছু, যা কেউই চায়নি। এইভাবে অতীত ইতিহাস একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ারূপেই চলে এবং মূলত একই গতির নিয়মাবলীর অধীন। যদিও ব্যক্তিগত ইচ্ছা প্রত্যেক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শারীরিক গঠন এবং বাহিরের, শেষ পর্যন্ত, অর্থনৈতিক অবস্থার দ্বারা (নিজের ব্যক্তিগত অবস্থা বা সাধারণভাবে সমাজের অবস্থা) প্রণোদিত হয় এবং নিজ নিজ ঈপ্সিত বস্তু লাভ করতে পারে না বরং একটি যৌথ গড়ে একটি সাধারণ লব্ধিতে পরিণত হয়, তাই বলে কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কিছুতেই করা চলে না যে, তাদরে মূল্য শূন্য। বরঞ্চ লব্ধ ফলে প্রত্যেকটি ইচ্ছারই অবদান রয়েছে এবং সেই পরিমাণে সেগুলি তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

এই তত্ত্বটিকে অপরের মুখ থেকে না শুনে মূল উৎস থেকে শুনে মূল উৎস থেকে অনুশীলন করার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। সত্যই সেটা অনেক বেশি সোজা। মার্কস এমন কিছুই লেখেননি, যার মধ্যে এ তত্ত্বের ভূমিকা নেই। কিন্তু, বিশেষ করে ‘লুই বোনাপার্টের আঠারোই ব্রুমেয়ার’[২] এই তত্ত্বপ্রয়োগের সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। পুঁজি গ্রন্থের মধ্যেও এর বহু নিদর্শন রয়েছে। আমি আপনাকে আমার এই লেখাগুলিও পড়তে বলব; ‘শ্রী ডুরিং এর বিজ্ঞানে বিপ্লব’ ও ‘ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ এবং চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’।[৩] সেখানে আমি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিশদতম বিবরণ যতটা বর্তমান বলে আমি জানি তা উল্লেখ করেছি।

আরো পড়ুন:  সমাজতান্ত্রিক সমাজের শ্রেণি কাঠামোর প্রকৃতি

তরুণেরা যে অনেক সময় অর্থনৈতিক দিকের ওপর যতখানি উচিত তার চেয়ে বেশি জোর দিয়ে থাকেন, তজ্জন্য মার্কস ও আমি, আমরা নিজেরাই কিছুটা দায়ি। আমাদের প্রতিপক্ষীয়েরা অস্বীকার করতেন বলেই তাঁদের বিপরীতে অর্থনৈতিক দিকটির ওপর আমাদের জোর দিতে হয়েছিলো। পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত অন্যান্য দিকগুলিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ার মতো সময়, স্থান বা সুযোগ আমরা পাইনি। কিন্তু ইতিহাসের কোনো যুগকে উপস্থিত করার প্রশ্ন যখন এসেছে, অর্থাৎ বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের প্রশ্ন যখন এসেছে, তখন অন্যকথা, এবং কোনো ভুল হবার সম্ভাবনা থাকেনি। দুর্ভাগ্যক্রমে, অবশ্য, প্রায়ই দেখা যায় যে, লোকে ভাবে, তারা একটি নতুন তত্ত্ব বুঝে ফেলেছে এবং ঐ তত্ত্বের প্রধান প্রধান নীতিগুলি আয়ত্ত করার সংগে সংগেই সঙ্গেই এমনকি অনেকসময় ভুলভাবে আয়ত্ত করার সংগে সংগেই, বিনা দ্বিধাসঙ্কোচে তত্ত্বটিকে প্রয়োগ করতে তারা সক্ষম। হালে যাঁরা ‘মার্কসবাদী’ হয়েছেন তাঁদের অনেককেই আমি এই সমালোচনা থেকে রেহাই দিতে পারি না, কারণ এর দৌলতেও অতি আশ্চর্য রকমের আবর্জনা সৃষ্টি হয়েছে …[৪]

টিকা ও তথ্যসূত্র

১. এঙ্গেলস এই চিঠিটি লেখেন ইয়োসেফ ব্লকের কাছে। ইয়োসেফ ব্লক (ইংরেজি: Joseph Bloch) (১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৭১ – ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৬) ছিলেন একজন সমাজতান্ত্রিক সাংবাদিক। তিনি দীর্ঘদিন “Sozialistischen Monatshefte” পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি জার্মানির সমাজ-গণতান্ত্রিক দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ডানপন্থী ব্যক্তি ছিলেন। এই চিঠিটি এঙ্গেলস লিখেছিলেন ১৮৯০ সালের ২১ ও ২২ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে।

২. লুই বোনাপার্টের আঠারোই ব্রুমেয়ার কার্ল মার্কসের লেখা।

৩. ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ এবং চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান হচ্ছে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের লেখা।

৪. এখানে প্রদত্ত চিঠিটি নেয়া হয়েছে চার খন্ডে প্রকাশিত ‘মার্কস এঙ্গেলস রচনা সঙ্কলন’, দ্বিতীয় খন্ড, দ্বিতীয় অংশ; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো ১৯৭২-এর ১৭৫-১৭৭ পৃষ্ঠা থেকে)

Leave a Comment

error: Content is protected !!