১
কেউ যায় না
শুধু জায়গা বদলে বদলে
সব কিছুই
জায়গা বদলে বদলে
সকলেই
থাকে।
দেখ বাপু, আমি এসেছিলাম
এই পুরনো জায়গায়
সাদা চুলে
শেষবারের মতো
একবার মিলিয়ে নিতে
ছেলেবেলার ছবিগুলো।
যেদিকে তাকাই
জানলাগুলো
পর্দা দিয়ে ঢাকা।
ভেতরের একটা চেনা মুখও
বাইরে
আমার নজরে আসছে না।
রেলিঙের আগুন-রঙের শাড়িগুলো
পাট ক’রে
আলনায় তোলা।
রাস্তায় মাঞ্জা-দেওয়া সব সুতোই
এখন
লাটাইতে গোটানো।
দূর হোক গে –
২
পাখি উড়ে গেছে।
উড়ে গেছে আলোর নীল পাখিটা!
তাই মুখ কালো ক’রে
অভিমানে
দেয়ালে ঠিকরে আছে
মরচে-ধরা লতাপাতায়
লোহার বাসরে
শূন্য খাঁচা।
আলোর নষ্টনীড়ে উধাও
মই কাঁধে উধাও
বুড়ো বাতিওয়ালা।
হায়, উড়ে গেছে নীল পাখিটা।
৩
দরজ৷ থেকে এক দৌড়ে
একেবারে
মটকায় উঠে গেছে সিঁড়িটা
( যেখানে পায়রার খোপ,
যেখানে তুলসীর টব )
আবার নাচতে নাচতে এক দৌড়ে
দোরগোড়ায়
যেখানে ঠিক তার পায়ের কাছে
ভয়ংকর ভারী লোহার ঢাকনায়
দম-বন্ধ-করা
সুড়ঙ্গের হাঁ-মুখ
ডাকতে গিয়ে
দরজা থেকে আমাকে ফিরে আসতে হল –
পুরনো দিনের সঙ্গীদের নাম
এখন আর
কিছুতেই আমার মনে পড়ছে না ।।
৪
তাছাড়া এও এক মজা মন্দ নয় –
একদিন যেখানে ঘেরাটোপে
কলেজের বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামত
জজ সাহেবের নাতনি
সেখানে তিন জোয়ান তিন ধিঙ্গি
গল্পে গল্পে
পাড়া মাথায় করে নিয়ে চলেছে।
আমাদের কবরেজ মশাই গো—
বৈঠকখানার ফরাসবিছানা তুলে দিয়ে
তার নাতিরা খুলেছে ঠিকেদারের কেতাদুরস্ত আপিস।
আর তার কত রকমের হাম্বাই।
মুখোমুখি আয়না বসিয়ে
হাফ-দরজায়
চুলছাটার সেলুন
গোয়ালঘরে ছাপাখানা
উঠোনে লেদ
হরিসভার কানে তালা ধরিয়ে
টাইপ শেখার ইস্কুল—
ঘড়ি ঘড়ি বদলাচ্ছে হে দুনিয়া ।।
৫
যারা ভুলে গিয়েছিল –
তারা এখন
মোমবাতিগুলো ফুঁ দিয়ে নেভাচ্ছে
তার মানে
এ-গলি একটু আগে
অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল।
ছাপাখানার চাপযন্ত্রে
গম-ভাঙার কলে
চারিদিকে আবার সব
গমগম করছে।
তার মানে
একটু আগে এলে
এক নিষ্প্রদীপ নৈঃশব্দ্যে
আমি দেখতে পেতাম
মাথার ওপর
অনন্তনীলচক্র
কান পাতলে শুনতে পেতাম
উৎসে ফিরে যাবার
ছলাৎছল শব্দ।
আমি পেছন ফিরতেই
কোথাও গনগনে আঁচে
কিছু একটা সাঁতলাবার আওয়াজে
হঠাৎ এ-গলির বুকটা
ছঁত করে উঠল।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ – ৮ জুলাই ২০০৩) ছিলেন বিশ শতকের উল্লেখযোগ্য বাঙালি বামপন্থী কবি ও গদ্যকার। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও ছড়া, প্রতিবেদন, ভ্রমণসাহিত্য, অর্থনীতিমূলক রচনা, অনুবাদ, কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা, উপন্যাস, জীবনী, শিশু ও কিশোর সাহিত্য ইত্যাদি রচনাতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ এবং বহু দেশি-বিদেশি কবিতা বাংলায় অনুবাদও করেছেন। “প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য় এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা” বা “ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত” প্রভৃতি তাঁর অমর পঙক্তি বাংলায় আজ প্রবাদতুল্য।