এই ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছিল শ্রমজীবি মানুষের সমিতি “কমিউনিস্ট লীগ”এর কর্মসূচি হিসেবে, যে সংগঠন প্রথমে কেবল জার্মান পরে আন্তর্জাতিক, ১৮৪৮ এর আগের মহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অধীনে অনিবার্যভাবে এক গোপন সমিতি। লন্ডনে ১৮৪৭ এর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত লীগের এক কংগ্রেসে মার্কস ও এঙ্গেলস দায়িত্বপ্রাপ্ত হন প্রকাশনার জন্য এক পুর্ণাঙ্গ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পার্টি কর্মসুচি রচনার। জার্মান ভাষায় প্রস্তুত পান্ডুলিপি জানুয়ারি ১৮৪৮-এ লন্ডনে মুদ্রাকরের কাছে পাঠানো হয় ২৪ ফেব্রুয়ারীর ফরাসী বিপ্লবের[১] কয়েক সপ্তাহ আগে। জুন ১৮৪৮ অভ্যুত্থানের অল্প কিছুকাল আগে প্যারিসে একটা ফরাসী অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। মিস হেলেন ম্যাকফারলেন কর্তৃক প্রথম ইংরেজী অনুবাদ আবির্ভুত হল ১৮৫০-এ লন্ডনে জর্জ জুলিয়ান হার্নের “রেড রিপাবলিকান”-এ। একটা ড্যানিশ ও একটা পোলিশ সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছিল।
জুন ১৮৪৮ এর প্যারিসীয় অভ্যুত্থান — যা ছিল সর্বহারা শ্রেণির আর বুর্জোয়ার মধ্যে প্রথম বিরাট যুদ্ধ — এর পরাজয় ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণির সামাজিক ও রাজনৈতিক আশা আকাঙ্খাকে আবারো একটা সময়ের জন্য পেছনে ঠেলে দিল। তারপর ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের আগে যেমনটা ছিল তেমনিভাবে আবারো আধিপত্যের সংগ্রাম সীমাবদ্ধ থাকল মালিক শ্রেণিগুলির মধ্যে; শ্রমিক শ্রেণি রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াইয়ে নেমে আসে আর মধ্যবিত্ত র্যাডিক্যালদের চরমপন্থী অংশের অবস্থানে এসে দাঁড়ায়। যেখানেই স্বাধীন সর্বহারা আন্দোলন জীবনের চিহ্ন দেখাতে থাকে, সেখানেই তার উপর নির্মমভাবে দমন চালানো হল। এভাবে প্রুশীয় পুলিশ তখন কোলনে অবস্থিত কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় পরিষদের উপর হানা দিল। সদস্যদের গ্রেফতার করা হয় আর আঠার মাসের কারাবাসের পর তারা ১৮৫২ এর অক্টোবরে বিচারের মুখোমুখি হন। এটা “কলোন কমিউনিস্টদের বিচার” নামে পরিচিতি পায় যা ৪ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত চলে, যাতে বন্দীদের মধ্যে সাত জনের তিন থেকে ছয় বছরের দুর্গ কারাবাস হয়। রায়ের পরপরই লীগের বাকি সদস্যগণ লীগকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দিলেন। “ইশতেহার” এর কথা বলা যায়, এটা তারপরে মনে হল ভুলে যাওয়া হয়েছে।
যখন ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণি শাসক শ্রেণিসমূহের উপর আরেকটা আক্রমণের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয় করল, শ্রমজীবি মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি আবির্ভূত হল। কিন্তু এই সমিতি, ইউরোপ ও আমেরিকার সমগ্র জঙ্গি সর্বহারা শ্রেণিকে একটি সংস্থার মধ্যে আনার ইচ্ছায় গঠিত হলেও “ইশতেহার”-এ স্থাপিত মূল নীতি একবারে ঘোষণা করতে পারল না। আন্তর্জাতিক বাধ্য ছিল এমন একটা কর্মসূচি নিতে যা যথেষ্ট ব্যাপক হবে ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়নের নিকট, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি ও স্পেনে প্রুঁধোর[২] অনুসারীদের নিকট, আর জার্মানীতে লাসালপন্থীদের[৩] নিকট গ্রহণযোগ্য হতে। মার্কস যিনি এই কর্মসূচি রচনা করেন সকল পক্ষসমূহকে তুষ্ট করে শ্রমিক শ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উপর সম্পূর্ণভাবে আস্থা রেখেছিলেন যা যৌথ তৎপরতা ও পারস্পরিক আলোচনা থেকে ঘটতে বাধ্য ছিল। পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঘটনাধারা ও বিপর্যয়সমূহ, বিজয়ের চেয়ে এমনকি বেশি পরাজয়সমূহ, শ্রমিকদের মনে তাদের সাধের টোটকাগুলির অপর্যাপ্ততার উপলব্ধি আনয়ন না করে পারে না, আর শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির প্রকৃত শর্ত সম্পর্কে এক অধিকতর পরিপুর্ণ অন্তর্দৃষ্টি না এনে পারে না। আর মার্কস ছিলেন সঠিক। আন্তর্জাতিক ১৮৭৪ সালে ভেঙে যাওয়ার পর শ্রমিকদের এনে দিল ১৮৬৪-এ তাদের যে লোক ছিল তার থেকে ভিন্ন লোক। ফ্রান্সে প্রুঁধোবাদ, জার্মানীতে লাসালবাদ শুকিয়ে মরছিল, এমনকি রক্ষণশীল ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়নগুলি, যদিও এদের প্রায় সবাই আন্তর্জাতিকের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে তুলেছিল অনেক আগে থেকেই, সেই দিকে ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হচ্ছিল যাকে গত বছর সোয়ানশিতে তাদের সভাপতি [ডবলিউ বিভেন] তাদের নামে বলে, “মহাদেশীয় সমাজতন্ত্র আমাদের কাছে আর বিভীষিকা নেই”। বস্তুত, “ইশতেহার” এর নীতিমালা সকল দেশের শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে বিবেচনাযোগ্য স্থানলাভ করেছে।
কমিউনিস্ট ইশতেহারের সূচিপত্র
১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
১৮৮২ সালের রুশ সংস্করণের ভূমিকা
১৮৮৩ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকা
১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
১৮৯২ সালের পোলীয় সংস্করণের ভূমিকা
১৮৯৩ সালের ইতালীয় সংস্করণের ভূমিকা
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার
১. বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত
২. প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিস্টগণ
৩. সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সাহিত্য
(১) প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র
ক. সামন্ত সমাজতন্ত্র
খ. পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র
গ. জার্মান অথবা “খাঁটি” সমাজতন্ত্র
(২) রক্ষণশীল অথবা বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র
(৩) সমালোচনী — কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম
৪. বর্তমান নানা সরকার-বিরোধী পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধ।
টীকা
এভাবে “ইশতেহার” নিজে আবারো সামনে চলে এল। ১৯৫০ সাল থেকে জার্মান পাঠ পুনমুদ্রিত হয় সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বেশ কয়েকবার। ১৮৭২ সালে নিউইয়র্কে এটা ইংরেজী ভাষায় অনুদিত হয় যা “উডহল ও ক্লফিন’স সাপ্তাহিক”-এ প্রকাশিত হয়। এই ইংরেজী অনুবাদ থেকে নিউ ইয়র্কের “লা সোশ্যালিস্ত”-এ একটা ফরাসী তৈরি করা হয়। তারপর থেকে কমপক্ষে আরো দুটি ইংরেজী অনুবাদ কমবেশী বিকৃত আকারে বের করা হয় আমেরিকায়, যার একটি ইংলন্ডে পুনমুদ্রিত হয়। বাকুনিন কর্তৃক প্রথম রুশ অনুবাদ ১৮৬৩-এর দিকে জেনেভায় হের্তসেনের “কলোকোল” দপ্তর প্রকাশ করে; দ্বিতীয় অনুবাদটিও জেনেভায় ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় বীরোচিত ভেরা জাসুলিচ কর্তৃক অনুদিত হয়ে । এক নতুন ড্যানিশ সংস্করণ পাওয়া যায় ১৮৮৫-এ কোপেনহেগেন-এর “সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক বিব্লিওথেক”-এ; একটা নতুন ফরাসী অনুবাদ প্যারিসে ১৮৮৬ সালে “লা সোশ্যালিস্ত”-এ পাওয়া যায়। এই শেষেরটা থেকে মাদ্রিদে একটা স্প্যানিশ সংস্করণ প্রস্তুত ও প্রকাশ হয় ১৮৮৬ সালে । জার্মান পুনমুদ্রণ অগনন, কমপক্ষে সবমিলিয়ে বারটি। একটা আর্মেনিয়ান অনুবাদ যা কনস্টান্টিনোপলে প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল কয়েক মাস আগে, তা আলোর মুখ দেখেনি। আমাকে বলা হল প্রকাশক মার্কসের নামে বই বের করতে ভয় পান, আর অনুবাদক তা নিজ সৃষ্ট হিসেবে দেখাতে অনিচ্ছুক। অন্যান্য ভাষায় আরো অনুবাদের কথা আমি শুনেছি, কিন্তু আমি দেখিনি। এভাবে “ইশতেহার”এর ইতিহাস বিরাটাকারে আধুনিক শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটায়; বর্তমানে নিঃসন্দেহে এটা সকল সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের মধ্যে সর্বাধিক বিস্তৃত, সর্বাধিক আন্তর্জাতিক কীর্তি, সাইবেরিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত কোটি কোটি শ্রমজীবি মানুষ কর্তৃক স্বীকৃত সাধারণ প্লাটফরম।
তথাপি, যখন এটা রচিত হয় একে সমাজতান্ত্রিক ইশতেহার বলা সম্ভব ছিল না। ১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্রী বলতে বোঝাতো, একদিকে বহুবিধ কল্পলৌকিক মততন্ত্রের অনুগামীদেরঃ ইংল্যান্ডে ওয়েনপন্থীরা[৪], ফ্রান্সে ফুরিয়েপন্থীরা[৫], উভয়ে স্রেফ একটা গোষ্ঠীতে ইতিমধ্যে সীমিত হয়ে এসে ক্রমান্বয়ে লোপ পাচ্ছিল; অন্যদিকে বোঝাত সমাজের বিচিত্র সব হাতুড়েদের যারা তাদের সকল প্রকার তুকতাক দ্বারা পুঁজি ও মুনাফার কোন ক্ষতি না করে, সকল প্রকার সামাজিক অভিযোগের প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি দিত, উভয় ক্ষেত্রের লোকেরাই ছিল শ্রমিক শ্রেণির বাইরের, যারা “শিক্ষিত” শ্রেণিগুলির সমর্থনের দিকে তাকিয়ে ছিল। শ্রমিক শ্রেণির যে অংশ মনে করছে যে স্রেফ রাজনৈতিক বিপ্লব যথেষ্ট নয় আর এক সামগ্রিক সামাজিক পরিবর্তন আবশ্যক, সে অংশটা নিজেকে কমিউনিস্ট বলত। এটা ছিল অমার্জিত, স্থূল, খাঁটি সহজবোধের কমিউনিজম, তথাপি তা মূল প্রশ্নকে স্পর্শ করে আর শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল ফ্রান্সে কাবের আর জার্মানীর ওয়েটলিং-এর[৬] ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র সৃষ্টি করতে। তাই, সমাজতন্ত্র ১৮৪৭ সালে ছিল একটা মধ্যবিত্ত আন্দোলন, কমিউনিজম ছিল শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন। সমাজতন্ত্র ছিল মহাদেশে অন্ততঃ “সম্মানিত”; আর কমিউনিজম ছিল খুবই বিপরীত। আর যেহেতু আমাদের মত প্রথম থেকেই ছিল এই যে “শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি হওয়া চাই শ্রমিক শ্রেণিরই নিজস্ব কাজ”, [৭] তাই কোনই সন্দেহ ছিল না এই দুই নামের মধ্যে আমরা কোনটা নেব। অধিকন্তু, আমরা আজ পর্যন্ত এ নাম বর্জন করার কথা ভাবিওনি।
ইশতেহার ছিল আমাদের যৌথ সৃষ্টি, তবু আমার মনে হয় আমি বলতে বাধ্য যে এর মর্ম গঠনকারী মূল বক্তব্য মার্কসেরই। সেই মূল বক্তব্য হলঃ প্রত্যেক ঐতিহাসিক যুগে যে আধিপত্যকারী অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বিনিময়ের পদ্ধতি ও তা থেকে যে সমাজের কাঠামো আবশ্যিকভাবে উদ্ভূত হয়, তা হচ্ছে একটা ভিত্তি যার উপর ঐ যুগের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃদ্ধিক ইতিহাস গড়ে উঠে ও একমাত্র তার দ্বারাই এর ব্যাখ্যা করা যায়; ফলতঃ সমগ্র মানবজাতির ইতিহাস (ভুমির সাধারণ মালিকানা সম্বলিত আদিম উপজাতীয় সমাজের বিলোপের পর থেকে) হচ্ছে শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস, শোষক ও শোষিত, শাসক ও নিপীড়িত শ্রেণীসমূহের মধ্যে সংগ্রামের ইতিহাস, আর এই সংগ্রামের ইতিহাস বিবর্তনের এক ধারা গঠন করে আজকের দিনে এমন স্তরে উপনীত হয়েছে যেখানে শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণী — সর্বহারা শ্রেণী — তাকে শোষণ ও নিপীড়ণ করে যে শ্রেণী – বুর্জোয়া — থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনা সমগ্র সমাজকে সকল শোষণ, নিপীড়ণ, শ্রেণী পার্থক্য ও শ্রেণী সংগ্রাম থেকে চিরতরে মুক্ত না করে।
এই প্রস্তাবনা, যা আমার বিবচেনায় ইতিহাসের জন্য তাই করেছে ডারউইনের তত্ত্ব[৮] জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা করেছে। ১৮৪৫ এর কিছু বছর আগে থেকে আমরা উভয়ে ক্রমন্বয়ে এর দিকে এগুচ্ছিলাম। আমি স্বাধীনভাবে যতটুকু এর দিকে এগিয়েছিলাম তা আমার ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর ভুমিকা’[৯] বইয়ে সবচেয়ে ভালভাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমি যখন পুনরায় মার্কসের সাথে ব্রাসেলসে মিলিত হলাম ১৮৪৫-এর বসন্তে, তিনি এটা ইতিমধ্যেই প্রস্তুত করে ফেলেছেন আর আমার কাছে উপস্থাপন করলেন, এখন আমি যতটা পরিষ্কারভাবে এখানে ব্যক্ত করেছি ততটাই।
১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণে আমাদের যৌথ ভূমিকা থেকে আমি এখানে উদ্ধৃত করতে চাই নিচের অংশটিঃ
বিগত পঁচিশ বছরে অনেক ওলট পালট ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু ইশতেহারে স্থাপিত মৌলিক নীতিমালা সামগ্রিকভাবে আজকেও একই আছে। এখানে সেখানে কিছু বিস্তারিত ব্যাখার উন্নতি হয়েছে। ইশতেহার যেমনটা বলেছে, সবক্ষেত্রে ও সকল সময়ে নীতিমালার ব্যবহারিক প্রয়োগ নির্ভর করছে সে সময়ের ঐতিহাসিক শর্ত সমূহের উপর আর তাই, দ্বিতীয় অংশের শেষে কোন বিপ্লবী পদক্ষেপ প্রস্তাবিত হয়নি। আজকে ঐ অনুচ্ছেদটি অনেক দিক থেকেই খুবই ভিন্নভাবে লিখতে হত। বিগত পঁচিশ বছরে আধুনিক শিল্পের অতিকায় অগ্রগতি, বিকশিত ও সম্প্রসারিত শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি সংগঠনগুলিসমেত, আর প্রথমে ফ্রেব্রুয়ারী বিপ্লব তারপর তার চেয়ে আরো বেশি যা সেই প্যারী কমিউন[১০] যেখানে সর্বহারা শ্রেণী সর্বপ্রথমবারের মত দুই মাসের জন্য ক্ষমতা দখল করে রাখে, ইত্যাদি প্রেক্ষিতে ইশতেহারের কর্মসূচি কিছু বিস্তারের দিক থেকে সেকেলে হয়ে গেছে। কমিউন বিশেষভাবে এই জিনিসটা প্রমাণ করেছে যে “শ্রমিক শ্রেণী তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে দখল করেই নিজের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করতে পারে না।”[১১] এটা আরো স্বতসিদ্ধ যে সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের সমালোচনা আজকের দিনের তুলনায় কম আছে, কারণ সেটা ছিল কেবল ১৮৪৭ পর্যন্ত; একইভাবে বিভিন্ন বিরোধী পার্টির সাথে কমিউনিস্টদের সম্পর্কের উপর মন্তব্য (চতুর্থ অধ্যায়ে) যদিও নীতিগতভাবে এখনো সঠিক, তবু ব্যবহারিকভাবে সেকেলে হয়ে গেছে, কেননা রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমগ্রভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, আর ইতিহাসের প্রগতি অধিকাংশ রাজনৈতিক পার্টিকেই ঝেটিয়ে বিদায় করেছে।
কিন্তু ইশতেহার একটা ঐতিহাসিক দলিল হয়ে গেছে যার পরিবর্তন করার কোন অধিকার আর আমাদের নেই।
মার্কসের ‘পুঁজি’ গ্রন্থের বেশির ভাগের অনুবাদক জনাব স্যামুয়েল মুর এই অনুবাদ করেছেন। আমরা দুজনে মিলে এর সংশোধন করেছি। কয়েকটি ঐতিহাসিক উল্লেখের ব্যাখ্যা হিসেবে কিছু টীকা আমি সংযোজন করেছি।
লন্ডন, ৩০ জানুয়ারী ১৮৮৮
টিকা:
১. ফ্রান্সে ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে।
২. পিয়েরে জোসেফ প্রুধো (১৮০৯- ১৯৬৫) ফরাসি প্রাবন্ধিক অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক।
৩. লাসাল জার্মান ক্ষুদে বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী। এঙ্গেলস টীকায় লিখেছিলেন যে ‘লাসাল আমাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে সর্বদাই স্বীকার করতেন যে, তিনি মার্কসের শিষ্য এবং সেই হিসেবে ইশতেহারই তার ভিত্তি। কিন্তু ১৮৬২-৬৪ সালের প্রকাশ্য আন্দোলনে তিনি রাষ্ট্রের ঋণের সাহায্যে উৎপাদক সমবায়ের দাবির বেশি অগ্রসর হননি’।
৪. ব্রিটিশ কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী রবার্ট ওয়েন (১৭৭১-১৮৫৮) ও তার অনুগামীরা।
৫. ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী শার্ল ফুরিয়ে (১৭৭২-১৮৩৭) এবং তাঁর সমর্থকেরা।
৬. এতিয়েন কাবে (১৭৮৮-১৮৫৬) ফরাসি ক্ষুদে বুর্জোয়া প্রাবন্ধিক। ভিলহেল্ম ভাইতলিং (১৮০৮-১৮৭১) গোড়ার দিককার জার্মানির শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের নেতা।
৭. ১৮৪০ এর দশক থেকে মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের বেশ কিছু রচনায় এই স্বতসিদ্ধটি ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখিত সূত্রটির জন্য “আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতির সাধারণ বিধিসমূহ” দ্রষ্টব্য।
৮. চার্লস রবার্ট ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী, বস্তুবাদী জীববিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা।
৯. ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা — ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস, অনুবাদঃ ফ্লোরেন্স কে উইশ্চেনতস্কি, নিউ ইয়র্ক, লোভেল—লন্ডন। ডব্লিউ রীভস, ১৮৮৮, এঙ্গেলসের টীকা
১০. ১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউনের কথা বলা হচ্ছে। এটি ছিল প্রথম প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী সরকার।
১১. দেখুন ফান্সে গৃহযুদ্ধ; আর এই পয়েন্টটাকে আরো বিকশিত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতির সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা, লন্ডন, ট্রুলাভ, ১৮৭১, পৃঃ ১৫।
কার্ল মার্কসের সাথে মার্কসবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস (২৮ নভেম্বর, ১৮২০ – ৫ আগস্ট ১৮৯৫) ছিলেন জার্মান বিপ্লবী, দার্শনিক, সমাজ বিজ্ঞানী, লেখক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে “পবিত্র পরিবার” (১৮৪৪), “ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা” (১৮৪৫) “এ্যান্টি-ডুরিং” (১৮৭৮) “প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা (১৮৮৩), “পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি” (১৮৮৪) প্রভৃতি। ১৮৪৮ সালে ছাপা মার্কস ও এঙ্গেলসের সুবিখ্যাত “কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার”।