কমিউনিস্ট ইশতেহারের ১৮৯২ সালের পোলীয় সংস্করণের ভূমিকা

‘কমিউনিস্ট ইশতেহারের’ একটি নূতন পোলীয় সংস্করণের যে প্রয়োজন হলো তাতে নানা কথা মনে আসে।

প্রথমত, ‘ইশতেহারটি’ যেন ইদানীং ইউরোপীয় ভূখণ্ডে বৃহদায়তন শিল্প বিকাশের একটা সূচক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এক একটি দেশে বৃহদায়তন শিল্প যে পরিমাণে বাড়ে, সেই পরিমাণেই মালিক শ্রেণিগুলির তুলনায় শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব শ্রেণিগত অবস্থান থেকে জ্ঞানলাভের জন্য আগ্রহ বাড়ে; তাদের মধ্যে প্রসার লাভ করে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও ‘ইশতেহারের’ চাহিদা বাড়ে। তাই শুধু শ্রমিক আন্দোলনের অবস্থা নয়, প্রতি দেশে বৃহদায়তন শিল্প বিকাশের মাত্রাও বেশ সঠিকভাবে মাপা যায় সে দেশের ভাষায় ‘ইশতেহারের’ কত কপি বিক্রি হয়েছে তা দেখে।

সেই হিসাবে নৃতন পোলীয় সংস্করণটি থেকে পোলীয় শিল্পের একটি নিশ্চিত অগ্রগতির সূচনা মিলছে। দশ বছর আগের সংস্করণটি প্ৰকাশিত হবার পর যে এই প্ৰগতি সত্যই ঘটেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। রুশী পোল্যান্ড, কংগ্রেসী পোল্যান্ড[১] হয়ে উঠেছে রুশ সাম্রাজ্যের বৃহৎ শিল্পাঞ্চল। রুশ বৃহদায়তন শিল্প খাপছাড়াভাবে ছড়ানো—ফিনল্যান্ড উপসাগরের পাশে একটা অংশ, আর একটা অংশ মধ্যাঞ্চলে (মস্কো ও ভ্লাদিমির), তৃতীয় অংশটা কৃষ্ণ সাগর ও আজভ সাগরের উপকূলে, আরো কিছু অংশ অন্যত্ৰ—কিন্তু পোলীয় শিল্প অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র একটা অঞ্চলে জমাট-বাঁধা এবং এরূপ কেন্দ্রীভবনের সুবিধা ও অসুবিধা দুইয়েরই ফলভোগী। পোলীয়দের রুশীতে পরিণত করার ঐকান্তিক ইচ্ছা সত্ত্বেও রুশী কারখানামালিকেরা যখন পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে রক্ষণমূলক শুল্কের দাবি জানায় তখন তারা ঐ সুবিধার কথাটাই মানে। অসুবিধাটা পোলীয় কারখানামলিক ও রুশ সরকার উভয়ের পক্ষেই প্রকাশ পায় পোলীয় শ্রমিকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার দ্রুত প্রসারে ‘ইশতেহারের’ ক্রমবর্ধমান চাহিদায়।

কিন্তু রাশিয়াকে ছাড়িয়ে গিয়ে পোলীয় শিল্পের এই যে দ্রুত বিকাশ, সেটাই আবার পোলীয় জনগণের অফুরন্ত প্রাণশক্তির নূতন সাক্ষ্য এবং তার আসন্ন জাতীয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার নূতন গ্যারান্টি। এবং স্বাধীন শক্তিশালী পোল্যান্ডের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় শুধু পোলীয়দের স্বাৰ্থ নয়, আমাদের সকলেরই স্বাৰ্থ । ইউরোপীয় জাতিগুলির একটা সাচ্চা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্ভব হতে পারে কেবল যদি এই প্রত্যেকটা জাতির স্বদেশে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন থাকে। ১৮৪৮ খ্ৰীস্টাব্দের যে বিপ্লবে প্রলেতারীয় পতাকা তুলেও শেষ পর্যন্ত শুধু বুর্জোয়ার কাজটা করতে হয় প্রলেতারিয়েত যোদ্ধাদের, তাতেও ইতালি, জার্মানি ও হাঙ্গেরির স্বাধীনতা অর্জিত হয় তার দায়ভাগী ব্যবস্থাপক লুই বোনাপোর্ট ও বিসমার্ক মারফত। কিন্তু ১৭৯২ খ্রীস্টাব্দের পর থেকে একা পোল্যান্ড এই তিনটে দেশের চাইতেও বিপ্লবের জন্য অনেক বেশি কিছু করলেও ১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দে তার দশগুণ শক্তিশালী রুশী শক্তির কাছে হার মানবার সময় শুধু নিজের সম্পদের ওপরেই ভরসা করতে হয় তাকে। অভিজাত সম্প্রদায় পোলীয় স্বাধীনতা বজায় রাখতেও পারত না, পুনরুদ্ধার করতেও পারত না; আজকে বুর্জোয়ার কাছে। এ স্বাধীনতা, কম করে বললেও, তাৎপৰ্যহীন। তথাপি ইউরোপীয় জাতিগুলির সুসম সহযোগিতার জন্য তার প্রয়োজন আছে। তা অর্জন করতে পারে কেবল নবীন পোলীয় প্রলেতারিয়েত এবং তার হাতেই এ স্বাধীনতা নিরাপদ। ইউরোপের বাকী অংশের শ্রমিকদের পক্ষে পোল্যান্ডের স্বাধীনতা খোদ পোলীয় শ্রমিকদের মতোই প্রয়োজনীয়।

আরো পড়ুন:  কমিউনিস্ট নৈতিকতা সাম্যবাদী আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট জনগণের নৈতিকতার অনুশীলন

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস
লন্ডন, ১০ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৯২ খ্রীস্টাব্দ

টীকাঃ

[১] ভিয়েনা কংগ্রেসের (১৮১৪-১৮১৫) সিদ্ধান্ত অনুসারে পোল্যান্ডের যে অংশ রাশিয়ার কাছে যায়, তার কথা বলা হচ্ছে।  

কমিউনিস্ট ইশতেহারের সূচিপত্র
১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
১৮৮২ সালের রুশ সংস্করণের ভূমিকা
১৮৮৩ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকা
১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
১৮৯২ সালের পোলীয় সংস্করণের ভূমিকা
১৮৯৩ সালের ইতালীয় সংস্করণের ভূমিকা
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার
১. বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত
২. প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিস্টগণ
৩. সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সাহিত্য
(১) প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র
ক. সামন্ত সমাজতন্ত্র
খ. পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র
গ. জার্মান অথবা “খাঁটি” সমাজতন্ত্র
(২) রক্ষণশীল অথবা বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র
(৩) সমালোচনী — কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম
৪. বর্তমান নানা সরকার-বিরোধী পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধ
টীকা

Leave a Comment

error: Content is protected !!