সভাপতি মাও সে-তুঙের উদ্ধৃতি
৬. সাম্রাজ্যবাদ ও সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা কাগুজে বাঘ
*** সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা হচ্ছে কাগুজে বাঘ। প্রতিক্রিয়াশীলরা দেখতে ভয়াবহ, কিন্তু বাস্তবে তারা তত শক্তিশালী নয়। দূরদৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে প্রতিক্রিয়াশীলরা নয়, জনগণই প্রকৃতপক্ষে প্রবল শক্তির অধিকারী। মার্কিন সাংবাদিক আন্না লুইস স্ট্রংয়ের সাথে আলাপ (আগস্ট, ১৯৪৬)
*** পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু নেই যা দ্বৈত প্রকৃতিবিশিষ্ট নয় (অর্থাৎ বিপরীতের একত্বের নিয়ম), ঠিক একইভাবে সাম্রাজ্যবাদ এবং সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরাও দ্বৈত প্রকৃতিবিশিষ্ট, তারা একই সময়ে খাঁটি বাঘ ও কাগুজে বাঘ। ইতিহাসে ক্রীতদাসের মালিক শ্রেণি, সামন্ত জমিদার শ্রেণি এবং বুর্জোয়া শ্রেণি শাসনক্ষমতা দখলের পূর্বে ও পরে কিছুদিন প্রাণবন্ত, বিপ্লবী এবং প্রগতিশীল ছিল, তারা খাঁটি বাঘই ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের বিপরীত পক্ষ, অর্থাৎ ক্রীতদাস শ্রেণি, কৃষক শ্রেণি এবং সর্বহারা শ্রেণি ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠলো এবং অধিক থেকে অধিকতর তীব্রভাবে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলো, ফলে এই শাসক শ্রেণি ধাপে ধাপে বিপরীতে পরিবর্তিত হলো প্রতিক্রিয়াশীলগোষ্ঠীতে, পশ্চাৎপদ মানুষে ও কাগুজে বাঘে পরিবর্তিত হলো, তারা অবশেষে জনগণের দ্বারা উচ্ছেদ হলো বা উচ্ছেদ হবে। জনগণের জীবনমরণ সংগ্রামের সম্মুখীন হবার সময়েও প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাৎপদ, এবং ক্ষয়িষ্ণু শ্রেণিগুলো দ্বৈত প্রকৃতি বজায় রেখেছে। একদিকে তারা খাঁটি বাঘই—তারা মানুষ খায়, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষকে ভক্ষণ করে। জনগণের সংগ্রামের কাজকে দুরূহ বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হবার সময়ে অনেক আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। চীন দেশে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ততন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের শাসন ধ্বংস করার জন্য চীনা জনগণের একশ বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল, প্রায় কয়েক কোটি মানুষের প্রাণ বলি দিতে হয়েছিল, শুধু তার ফলেই ১৯৪৯ সালে বিজয়লাভ হয়েছে। দেখুন, এরা কি জ্যান্ত বাঘ, লোহার বাঘ এবং খাঁটি বাঘ ছিল না? কিন্তু পরিশেষে তারা কাগুজে বাঘে, মৃত বাঘে এবং বড়ির বাঘে পরিবর্তিত হয়েছে। এটা হচ্ছে ঐতিহাসিক তথ্য। মানুষ কি এসব তথ্য দেখেনি বা শোনেনি? বাস্তবিকই এই ধরনের হাজার হাজার সহস্র সহস্র বাস্তব তথ্য রয়েছে! সুতরাং বিষয়ের সারবস্তুকে বিবেচনা করে, দীর্ঘকালীন দৃষ্টিতে এবং রণনীতির দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদ ও সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রকৃতপক্ষে কাগুজে বাঘ বলেই দেখতে হবে। এর উপরই আমাদের রণনীতিগত চিন্তাধারা স্থাপন করা উচিত। অপরপক্ষে, তারা জ্যান্ত, লৌহ নির্মিত এবং খাঁটি বাঘও বটে, যা মানুষ খায়। এর উপরই আমাদের কৌশলগত ও যুদ্ধকৌশলগত চিন্তাধারা স্থাপন করা উচিত। “চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর উছাং অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণ” (১ ডিসেম্বর, ১৯৫৮)
*** আমি বলেছিলাম যে, সমস্ত তথাকথিত শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াশীলরাই কাগুজে বাঘমাত্র। কারণ তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। দেখুন, হিটলার কি কাগুজে বাঘ ছিল না? হিটলারের কি উচ্ছেদ হয়নি? আমি আরও বলেছিলাম, রাশিয়ার জার, চীনের সম্রাট এবং জাপানী সাম্রাজ্যবাদ সকলেই ছিল কাগুজে বাঘ। দেখুন, তাদের সকলেরই উচ্ছেদ হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এখনো উচ্ছেদ ঘটেনি। এবং এর হাতে এটম বোমা আছে; আমি দেখছি এটাও উচ্ছেদ হবে, এটাও একটা কাগুজে বাঘ। “বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও শ্রমিক পার্টির মস্কো সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ” (১৮ নভেম্বর, ১৯৫৭)
*** ‘পাথর তুলে নিজের পায়ে আঘাত করা, কোনো নির্বোধ লোকের আচরণের বর্ণনার জন্য এটা হচ্ছে চীনের একটা প্রচলিত প্রবাদ। সকল দেশের প্রতিক্রিয়াশীলরাই এ রকম নির্বোধ লোক। বিপ্লবী জনগণের উপর তাদের নানা প্রকারের অত্যাচার, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে কেবল আরও ব্যাপক ও তীব্রতার গণবিপ্লবের প্রেরণা দিতে পারে। রাশিয়ার জার ও চিয়াং কাইশেক যে বিপ্লবী জনগণের উপর নানা প্রকারের অত্যাচার করেছিল, সেটা কি মহান রুশ বিপ্লব ও মহান চীনা বিপ্লবের জন্য এই ধরনের প্রেরণার ভূমিকা গ্রহণ করেনি? “মহান অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সোভিয়েতের সভায় প্রদত্ত ভাষণ” (৬ নভেম্বর, ১৯৫৭)
*** বিগত নয় বছর ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের দেশের ভূখণ্ড তাইওয়ান দখল করে রেখেছে; আবার কিছুদিন আগে তারা সশস্ত্র বাহিনী পাঠিয়ে লেবানন আক্রমণ করে অধিকার করে রেখেছে। আমেরিকা সমগ্র বিশ্বের বহু দেশে কয়েক শ’ সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। চীনের ভূখণ্ড তাইওয়ান, লেবানন এবং বিদেশে সমস্ত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গলায় জড়ানো ফাঁসির দড়ি। এই ফাঁসির দড়িগুলো আর কেউ নয়, বরং মার্কিনীরা নিজেরাই প্রস্তুত করেছে। এবং তারা নিজেরাই তা নিজেদের গলায় জড়িয়েছে, আর ফাঁসির দড়ির অপর প্রান্ত চীনা জনগণ, আরব দেশগুলোর জনগণ ও পৃথিবীর সমস্ত দেশের শান্তিপ্রিয়, আক্রমণবিরোধী জনগণের হাতে তুলে দিয়েছে। মার্কিন হামলাকারীরা যত বেশি সময় এ সমস্ত দেশে থাকবে তাদের গলার ফাঁস ততই শক্ত হবে। “সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সভায় প্রদত্ত ভাষণ” (৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮)
*** সাম্রাজ্যবাদীরা বেশি দিন টিকে থাকবে না, কারণ তারা সব সময়ই কুকর্ম করে, সমস্ত দেশেই জনগণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের লালন পালনে রত থাকে, বহু উপনিবেশ, আধা উপনিবেশ এবং সামরিক ঘাঁটি বলপূর্বক দখল করেছে এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়ে শান্তিকে বিপদগ্রস্ত করছে। ফলে, সমগ্র পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি লোক বাধ্য হয়েই তাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে সংগ্রামে রুখে দাঁড়াচ্ছেন বা রুখে দাঁড়াবেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা এখনও বেঁচে আছে এবং এখনও তারা এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় যথা-ইচ্ছা জুলুম চালাচ্ছে। পাশ্চাত্য জগতে তারা এখনও নিজ-নিজ দেশের জনসাধারণকে অত্যাচার করছে। এইরূপ অবস্থাকে অবশ্যই বদলাতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের প্রধানত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণ ও অত্যাচারের অবসান ঘটানো সারা দুনিয়ার জনগণের কর্তব্য। “সিনহুয়া সংবাদ সংস্থার সংবাদদাতার সঙ্গে সাক্ষাৎকার” (২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮)
*** মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সর্বত্রই যথা-ইচ্ছা জুলুম চালাচ্ছে, ফলে নিজেকে সারা দুনিয়ার জনগণের শত্রুতে পরিণত করেছে এবং ক্রমে ক্রমে আরও বেশি করে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছে। সমস্ত লোক যারা গোলাম হতে নারাজ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতের এটম বোমা এবং হাইড্রোজেন বোমা কখনও তাদের ভীত করতে পারবে না। মার্কিন হামলাকারীর বিরুদ্ধে সারা দুনিয়ার জনগণের বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গ হচ্ছে দুর্বার। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম নিশ্চিতভাবে মহত্তর বিজয় লাভ করবে। “মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পানামার জনগণের ন্যায়সঙ্গত দেশপ্রেমমূলক সংগ্রামের সমর্থনে প্রদত্ত বিবৃতি” (১২ জানুয়ারী, ১৯৬৪)
*** মার্কিন একচেটে পুঁজিপতিচক্র যদি তাদের আক্রমণ নীতি ও যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য জেদ করে, তাহলে সেদিন অবশ্যই আসবে যেদিন সারা দুনিয়ার জনগণ তাদেরকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করবেন। অন্যান্য মার্কিন অনুচরদেরও ঠিক একই পরিণতি হবে। “সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সভায় প্রদত্ত ভাষণ” (৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮)
*** শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় আমরা এই ধারণায় উপনীত হয়েছি যে, রণনীতির দিক থেকে সমস্ত শত্রুকে আমাদের তুচ্ছ করে দেখতে হবে, যুদ্ধকৌশলের দিক থেকে তাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে শত্রুদেরকে অবশ্যই আমাদের তুচ্ছ করে দেখতে হবে, কিন্তু এক একটা বিশেষ প্রশ্নে তাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। যদি আমরা সামগ্রিকভাবে শত্রুদেরকে তুচ্ছ করে না দেখি, তাহলে আমরা সুবিধাবাদের ভুল করবো। মার্কস, এংগেলস যখন কেবল দুজনমাত্র ছিলেন, তখনই তারা ঘোষনা করেছিলেন যে, সমগ্র পৃথিবীতে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ হবেই। কিন্তু বিশেষ বিশেষ প্রশ্নে, এক একটা প্রশ্নে, যদি আমরা গুরুত্ব দিয়ে তাদের না দেখি, তাহলে আমরা হঠকারিতাবাদের ভুল করবো। শুধু এক একটা খণ্ডযুদ্ধ করেই যুদ্ধ করা যেতে পারে এবং শত্রুবাহিনী শুধু এক একটা অংশ করেই ধ্বংস করা যেতে পারে। কারখানাও শুধু এক একটা করে নির্মাণ করা যেতে পারে, কৃষক জমি চাষ করতে পারেন কেবলমাত্র খণ্ড খণ্ড করে, খাবার ব্যাপারেও এমনি। রণনীতিগতভাবে আমরা খাবার ব্যাপারটা তুচ্ছ করে দেখিঃ এটা খেয়ে আমরা শেষ করতে পারি। কিন্তু আসলে খাবার সময় আমরা এক এক গ্রাস করে খাই, গোটা একটা ভোজের খাবারকে এক গ্রাসে গেলা সম্ভব নয়। এটাকে বলা হয় পৃথক পৃথক সমাধান, সামরিক গ্রন্থে এটাকে বলা হয়, শত্রুবাহিনীকে একটা একটা করে ধ্বংস করা। “বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও শ্রমিক পার্টির মস্কো সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ” (১৮ নভেম্বর, ১৯৫৭)
*** আমার মতে বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি একটা নতুন সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। আজকের দুনিয়ায় দু’ধরনের বাতাস প্রবাহিত_ পূবালী ও পশ্চিমী বাতাস। চীনে একটি প্রবাদ আছে_ হয় পূবালী বাতাস পশ্চিমী বাতাসকে দাবিয়ে রাখে, না হয় পশ্চিমী বাতাস পূবালী বাতাসকে দাবিয়ে রাখে।” আমার মতে বর্তমান পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পূবালী বাতাস পশ্চিমী বাতাসকে দাবিয়ে রাখছে, এর অর্থ এই যে, সমাজতান্ত্রিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর অত্যধিক প্রাধান্য লাভ করেছে। ঐ
মাও সেতুং বা মাও সে তুং বা মাও জেদং (ইংরেজি: Mao Tse-Tung; ২৬ ডিসেম্বর ১৮৯৩ – ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ খ্রি.) মার্কসবাদী বিপ্লবী তাত্ত্বিক, সাম্যবাদী রাজনৈতিক নেতা, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং চীন ভূখন্ডের প্রায় শতাব্দীকালের সামাজিক রাজনীতিক মুক্তি ও বিপ্লবের নায়ক। জাপানি দখলদার শক্তি এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার কুওমিনটাং নেতা চিয়াং কাইশেকের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সামাজিক বিপ্লবের জন্য চীনের অগণিত এবং অনুন্নত কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কৌশলী হিসেবে মাও সেতুং এক সময় সমগ্র পৃথিবীতে সংগ্রামী মানুষের অনুপ্রেরণাদায়ক উপকথায় পরিণত হয়েছিলেন। তিনি অনেক জটিল কথাকে জনগণের সামনে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। জনগণের সেবায় মানবেতিহাসের সমস্ত জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন।