৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০
‘চীনের শ্রমিক’[১] পত্রিকার প্রকাশ একটা প্রয়োজন মেটাল। নিজের রাজনৈতিক পার্টি, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, কর্তৃক পরিচালিত হয়ে চীনের শ্রমিকশ্রেণি গত কুড়ি বছর ধরে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা করে এসেছেন, জনগণের মধ্যেকার রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সজাগ অংশে পরিণত হয়েছেন, এবং হয়ে উঠেছেন চীন বিপ্লবের নেতা। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কৃষক জনসাধারণ এবং সকল বিপ্লবী জনগণকে সমবেত করে তা সংগ্রাম করছে নয়া-গণতান্ত্রিক চীন প্রতিষ্ঠার জন্য ও জাপানী সাম্রাজ্যবাদকে বিতাড়িত করার জন্য, এবং তার অবদান এক্ষেত্রে অসামান্য। কিন্তু চীনের বিপ্লব আজ পর্যন্ত জয়যুক্ত হয়নি এবং খোদ শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ করার জন্যই বিরাট প্রয়াসের প্রয়োজন রয়ে গেছে, প্রয়োজন রয়ে গেছে – কৃষক জনগণ, পেটি-বুর্জোয়াদের অন্যান্য অংশ, বুদ্ধিজীবীবৃন্দ ও সমগ্র বিপ্লবী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করায়। এটা একটা সুবিপুল সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব। একাজ সুসম্পাদনের দায়িত্ব এসে পড়েছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, প্রগতিশীল কর্মীবৃন্দ এবং সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির উপর। শ্রমিক শ্রেণি এবং সামগ্রিকভাবে জনগণের চূড়ান্ত সাধিত হবে একমাত্র সমাজতন্ত্রের আঁওতায়, যে চুড়ান্ত লক্ষ্যসাধনের জন্য চীনের শ্রমিক শ্রেণীকে সংগ্রাম করতে হবে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের স্তরে আমাদের প্রবেশ করার আগে আমাদের যেতে হবে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এবং সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরের মধ্য দিয়ে। সুতরাং চীনের শ্রমিক শ্রেণির আশু কর্তব্য হলো নিজ শ্রেণির মধ্যে ঐক্যকে জোরদার করে তোলা, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরোধীতা করার জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং নতুন এক চীনের জন্য, নয়া-গণতন্ত্রের চীনের জন্য সংগ্রাম করা। ঠিক এই দায়িত্বটি সামনে রেখেই চীনের শ্রমিক প্রকাশিত হচ্ছে।
সহজ কথায় বলতে গেলে চীনের শ্রমিক প্রমিকদের কাছে বহুবিধ সমস্যার ব্যাপারে কেমন করে ও কেন-র প্রশ্নে-র ব্যাখ্যা করবে, প্রতিরোধ-যুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের বাস্তব অবস্থাযর কথা জানাবে এবং লব্ধ অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ করে এভাবে তার কর্তব্য সম্পাদনের প্রচেষ্টা করবে।
চীনের শ্রমিককে হয়ে উঠতে হবে শ্রমিকদের শিক্ষিত করার একটি বিদ্যালয় এবং তাদের মধ্যেকার কর্মীদের সুশিক্ষিত করে তোলার একটি বিদ্যালয় এবং পত্রিকার পাঠকেরাই হবেন তার ছাত্রবৃন্দ। শ্রমিকদের মধ্য থেকে বহু কর্মীবাহিনীকে শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজন রয়েছে, এমন সব কর্মী যারা ওয়াকিবহাল এবং সুদক্ষ, যারা শূন্যগর্ত খ্যাতির প্রত্যাশী নন এবং সততার সংগে কাজ করতে প্রস্তুত। এধরনের বিপুল সংখ্যক কর্মী ব্যতীত শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে মুক্তি অর্জন করা অসম্ভব।
শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের সাহায্যকে স্বাগত জানাবে এবং কখনোই তা প্রত্যাখ্যান করবে না। কারণ তাঁদের সাহায্য ছাড়া শ্রমিক শ্রেণি নিজে সামনে এগিয়ে যেতে পারে না বা বিপ্লবকে সফল করে তুলতে পারে না।
আমি আশা করি, পত্রিকাটি সুসম্পাদিত হবে এবং তাতে প্রচুর পরিমাণ প্রাণবন্ত লেখা প্রকাশিত হবে, কাঠখোট্টা ও নিরস যে প্রবন্ধাদি একঘেঁয়ে, নির্জীব ও অবোধ্য, সেগুলো তা সযত্নে পরিহার করবে।
প্রকাশিত হবার পর সাময়িক পত্রটিকে বিচার বিবেচনা করে ভালোভাবে চালাতে হবে। এটা একাধারে পাঠক ও পরিচালকবৃন্দ উভয়েরই দায়িত্ব। পাঠকদের পক্ষে নিজেদের পরামর্শ পাঠানো, সংক্ষিপ্ত চিঠিপত্র ও প্রবন্ধ লিখে তাঁরা কী পছন্দ বা অপছন্দ করেন তা জানিয়ে দেয়া খুবই দরকারি, কারণ একমাত্র এভাবেই সাময়িকপত্রটি সাফল্যমণ্ডিত হয়ে উঠবে। এই কটি কথা দিয়েই আমার প্রত্যাশা ব্যক্ত করলাম। তা-ই চীনের শ্রমিক-এর পরিচিতি জ্ঞাপক বক্তব্য হোক।[২]
টিকা:
১. চীনের শ্রমিক (দি চাইনিজ ওয়ার্কার) ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইয়েনানে প্রতিষ্ঠিত একটি মাসিক পত্রিকা। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ট্রেড ইউনিয়ন কমিশনের উদ্যোগে তা প্রকাশিত হয়।
২. অনুবাদটি নবজাতক প্রকাশন কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাও সেতুংয়ের নির্বাচিত রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডের ৫০৭-৫০৮ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে।
মাও সেতুং বা মাও সে তুং বা মাও জেদং (ইংরেজি: Mao Tse-Tung; ২৬ ডিসেম্বর ১৮৯৩ – ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ খ্রি.) মার্কসবাদী বিপ্লবী তাত্ত্বিক, সাম্যবাদী রাজনৈতিক নেতা, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং চীন ভূখন্ডের প্রায় শতাব্দীকালের সামাজিক রাজনীতিক মুক্তি ও বিপ্লবের নায়ক। জাপানি দখলদার শক্তি এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার কুওমিনটাং নেতা চিয়াং কাইশেকের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সামাজিক বিপ্লবের জন্য চীনের অগণিত এবং অনুন্নত কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কৌশলী হিসেবে মাও সেতুং এক সময় সমগ্র পৃথিবীতে সংগ্রামী মানুষের অনুপ্রেরণাদায়ক উপকথায় পরিণত হয়েছিলেন। তিনি অনেক জটিল কথাকে জনগণের সামনে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। জনগণের সেবায় মানবেতিহাসের সমস্ত জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন।