অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা

সভাপতি মাও সে-তুঙের উদ্ধৃতি

২৩. অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা

*** যারা বাস্তব কাজে নিযুক্ত তাঁদের প্রত্যেককে অবশ্যই নিম্নস্তরের অবস্থা সম্পর্কে তদন্ত করতে হবে। যারা শুধু তত্ত্ব জানেন কিন্তু বাস্তব অবস্থা জানেন না, তাঁদের জন্যই এ ধরনের তদন্ত কাজ বিশেষ করে দরকার। অন্যথায় তাঁরা তত্ত্ব ও অনুশীলনের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হবেন না। তদন্ত না করলে কথা বলার অধিকার নেই, আমার এই কথাটাকে যদিও ‘সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ’ বলে বিদ্রুপ করা হয়েছে, তবুও একথা বলার জন্য আজও আমি অনুশোচনা করি না; এর জন্য অনুশোচনা করা তো দূরের কথা, এ মতে আমি এখনও দৃঢ় আছি, তদন্ত না করলে কথা বলার কোনো অধিকার থাকতে পারে না। এমন অনেক লোক আছেন, যারা ‘সরকারি গাড়ি থেকে নামামাত্রই’ হৈ চৈ করে মতামত ঘোষণা করতে থাকেন, এটার সমালোচনা করেন, ওটার নিন্দে করেন, কিন্তু আসলে তাঁদের দশজনের মধ্যে দশজনই ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ এমন অভিমত বা সমালোচনা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়, এগুলো নিছক অজ্ঞ গালগল্প ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের পার্টিকে অসংখ্য বার এই সমস্ত তথাকথিত ‘রাজদূতদের’ হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। আর এই ধরনের ‘রাজদূত’ আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে, প্রায় সর্বত্রই বিরাজ করছে। স্ট্যালিন ঠিকই বলেন “বিপ্লবী অনুশীলনের সঙ্গে জড়িত না থাকলে তত্ত্ব উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে।” নিশ্চয়ই, তার কথা আবার ঠিক, ‘অনুশীলন যদি বৈপ্লবিক তত্ত্বকে নিজের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ না করে, তাহলে তা হয়ে পড়বে অন্ধ অনুশীলন।’ অন্ধ, ভবিষ্যতহীন ও অদূরদর্শী ‘বাস্তব ব্যক্তি’ ছাড়া আর কারো উপর ‘সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী’— এ লেবেল এঁটে দেওয়া চলে না। “পল্লীর তথ্যানুসন্ধানের ভূমিকা ও ক্রোড়লিপি” (মার্চ, এপ্রিল, ১৯৪১)

*** এই ধরনের মনোভাবই হচ্ছে তথ্য থেকে সত্য সন্ধানের মনোভাব। বাস্তবে যা আছে সেসবই হচ্ছে ‘তথ্য’, সত্যের অর্থ হচ্ছে তাদের অভ্যন্তরীণ সংযোগ, অর্থাৎ নিয়ম-বিধি, ‘সন্ধানের’ অর্থ হচ্ছে পর্যালোচনা করা। দেশ, প্রদেশ, জেলা অথবা মহকুমার ভেতরের ও বাইরের বাস্তব অবস্থা থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে এবং তার থেকেই আমরা আহরণ করবো সহজাত কিন্তু কাল্পনিক নয় এমন নিয়ম-বিধি, অর্থাৎ আমাদের কার্যকলাপের দিশারী হিসেবে পারিপার্শ্বিক ঘটনার অভ্যন্তরীণ সংযোগ। এটা করতে হলে অবশ্যই আত্মমুখী কল্পনা, ক্ষণিকের উৎসাহে মেতে উঠা এবং প্রাণহীন পুস্তকের উপরে নির্ভর করা চলবে না, বরং নির্ভর করতে হবে তথ্যের উপর যা বাস্তবে বিদ্যমান, উপকরণগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আয়ত্ত করতে হবে এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সাধারণ নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে এগুলো থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। “আমাদের শিক্ষা সংস্কার করুন” (মে, ১৯৪১)

আরো পড়ুন:  মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে?

*** ‘চোখ বুজে চড়ই ধরা’, ‘কানা লোকের মাছ ধরার মতো আচরণ করা, স্থুল ও বেখেয়াল হওয়া, আপন কথায় পাঁচ কাহন করা, ভাসাভাসা জ্ঞান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা—এইরূপ জঘন্য খারাপ রীতি এখনও আমাদের পার্টির অনেক কমরেডদের মধ্যে রয়েছে। এ রীতি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, আমাদের শিখিয়েছেন যে, মনোযোগের সঙ্গে অবস্থা পর্যালোচনা করা দরকার এবং আত্মমুখী আকাঙ্ক্ষা থেকে নয় বরং বাস্তবমুখী আসল অবস্থা থেকে শুরু করা উচিত; কিন্তু আমাদের অনেক কমরেড সরাসরি এ সত্যের পরিপন্থী। ঐ

*** আপনি কি এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন না? তাহলে, আপনি এই সমস্যার বর্তমান অবস্থান ও তার ইতিহাস অনুসন্ধান করুন! সমস্যাটাকে সম্পূর্ণ সুস্পষ্টভাবে অনুসন্ধান করলে তার সমাধান করার উপায় আপনি পাবেন। সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় অনুসন্ধানের পরে, আগে নয়। শুধু নির্বোধ ব্যক্তি একা অথবা একদল লোক সংগ্রহ করে অনুসন্ধান না করেই মূর্খের মতো মাথা ঘামিয়ে ‘উপায় ভাবতে থাকেন’, ‘ধারণা গড়তে থাকেন’। এ কথা বুঝা দরকার যে, এইভাবে কোনো ভাল উপায় ভেবে বের করা যায় না এবং কোনো ভাল ধারণা গড়ে তোলা যায় না। পুস্তক পূজার বিরোধিতা করুন” (মে, ১৯৩০)

*** অনুসন্ধান হচ্ছে ‘সুদীর্ঘ দশমাসব্যাপী গর্ভধারণের’ মতোই। সমস্যার সমাধান ‘কোনো সুন্দর প্রভাতে শিশুর জন্মলাভের’ মতোই। অনুসন্ধানই হচ্ছে সমস্যার সমাধান।

*** মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব ও পদ্ধতি দিয়ে চারদিকের পরিবেশকে সুব্যবস্থিতভাবে ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করা উচিত। কেবলমাত্র উৎসাহের উপর নির্ভর করেই কাজ করা চলবে না বরং স্ট্যালিন যেমন বলেন, বিপ্লবী মনোবলকে বাস্তবনিষ্ঠার সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে। “আমাদের শিক্ষা সংস্কার করুন” (মে, ১৯৪১)

*** অবস্থাকে জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে সামাজিক অনুসন্ধান চালানো, সমাজের সমস্ত শ্রেণীর বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো। যারা কাজ পরিচালনার ভার নিয়েছেন, তাদের পক্ষে অবস্থাকে জানার সবচেয়ে মৌলিক পদ্ধতি হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে কয়েকটি শহর ও গ্রাম আঁকড়ে ধরে মার্কসবাদের মৌলিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে, অর্থাৎ শ্রেণী বিশ্লেষণের পদ্ধতি দিয়ে কয়েকবার পুত্থানুপুঙ্খ অনুসন্ধান চালানো। “পল্লীর তথ্যানুসন্ধানের ভূমিকা ও ক্রোড়লিপি” (মার্চ, এপ্রিল, ১৯৪১)

আরো পড়ুন:  জনসাধারণের লাইন

*** অনুসন্ধান সভায় প্রত্যেকবারই বেশি লোকের উপস্থিত থাকার দরকার নেই, তিন থেকে পাঁচ কিংবা সাত থেকে আটজন হলেই যথেষ্ট। এর জন্য অবশ্যই সময় নিতে হবে, অনুসন্ধানসূচী অবশ্যই থাকতে হবে, আর অবশ্যই নিজের মুখে জিজ্ঞাসা করতে হবে ও নিজের হাতে লিখতে হবে এবং সভায় উপস্থিত লোকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাই বুকভরা উৎসাহ ছাড়া, নীচের দিকে তাকানোর দৃঢ় সংকল্প ছাড়া, জ্ঞান লাভের পিপাসা ছাড়া এবং বিশ্রী অতিদাম্ভিকতার আচরণ ত্যাগ করা ছাড়া ও আগ্রহশীল ছাত্র হবার মনোভাব ছাড়া নিশ্চয়ই এই কাজ করা অসম্ভব, তা ভালভাবে সম্পন্ন করাও অসম্ভব। ঐ

*** কমান্ডারের নির্ভুল বিন্যাস আসে তার নির্ভুল সংকল্প থেকে, তার নির্ভুল সংকল্প আসে তাঁর নির্ভুল বিচার থেকে, তাঁর নির্ভুল বিচার আসে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ থেকে এবং বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে সংগৃহীত তথ্যগুলোকে এক সূত্রে গেঁথে চিন্তা করা থেকে। কমান্ডার সমস্ত সম্ভাব্য ও প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণের পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, পর্যবেক্ষণে অর্জিত শত্রুর অবস্থা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যগুলোর উপর চিন্তা করেন—গাদ ছেড়ে সার বেছে, মিথ্যাকে বাদ দিয়ে সত্য রেখে, এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে গিয়ে, বাইর থেকে ভেতরে গিয়ে; তারপর তিনি তাঁর নিজের পক্ষের অবস্থাকে বিবেচনা করেন এবং উভয় পক্ষের তুলনা ও পারস্পরিক সম্পর্কের পর্যালোচনা করেন, এমনি করেই তিনি বিচার বিবেচনা গড়ে তোলেন, নিজের মন স্থির করেন এবং পরিকল্পনা রচনা করেন। এই হচ্ছে রণনীতিগত পরিকল্পনা, খণ্ডযুদ্ধের পরিকল্পনা বা লড়াইয়ের পরিকল্পনা রচনা করার পূর্বে সামরিক বিশেষজ্ঞের পক্ষে অবস্থাকে জানার সামগ্রিক প্রক্রিয়া। “চীনের বিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতি সমস্যা” (ডিসেম্বর, ১৯৩৬)

Leave a Comment

error: Content is protected !!