আত্মনির্ভরতা ও কঠোর সংগ্রাম

সভাপতি মাও সে-তুঙের উদ্ধৃতি

২১. আত্মনির্ভরতা ও কঠোর সংগ্রাম

*** কোন ভিত্তির উপরে আমাদের নীতি স্থাপিত হওয়া উচিত? নিজেদের শক্তির ভিত্তিতে, এটাকেই আত্মনির্ভরতা বলা হয়। আমরা বিচ্ছিন্ন নই, দুনিয়ার সমস্ত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশ ও জনগণই হচ্ছেন আমাদের বন্ধু। কিন্তু আমরা আত্মনির্ভরতার উপরেই জোর দিই, নিজেদের সংগঠিত শক্তির উপরে নির্ভর করে আমরা সমস্ত চীনা ও বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজিত করতে পারি। “জাপানবিরোধী যুদ্ধে বিজয়ের পরের পরিস্থিতি ও আমাদের নীতি” (১৩ আগস্ট, ১৯৪৫)

*** আমরা আত্মনির্ভরতার পক্ষে। আমরা বৈদেশিক সাহায্যের আশা করি, কিন্তু তার উপর আমরা নির্ভরশীল হয়ে থাকতে পারি না, আমরা নিজেদের প্রচেষ্টার এবং সমগ্র সৈন্যবাহিনী ও জনগণের সৃজনী শক্তির উপরেই নির্ভর করে থাকি। “অর্থনৈতিক কার্য চালনা শিখে নিতে হবে” (১০ জানুয়ারি, ১৯৪৫)

*** দেশব্যাপী বিজয়লাভ করাটা হচ্ছে দশ হাজার লি দীর্ঘ অভিযানের প্রথম পদক্ষেপ মাত্র।… চীনা বিপ্লব মহান, কিন্তু বিপ্লবের পরের পথ হবে আরও দীর্ঘতর, কাজটা হবে আরও মহান এবং আরও কঠোর। পার্টিতে এ কথাটা এখন অবশ্যই স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে, যাতে কমরেডরা বিনয়ী ও সতর্ক হবার রীতিকে, অহঙ্কার ও অসহিষ্ণুতার প্রতি সজাগ থাকার রীতিকে এবং কঠোর সংগ্রামের রীতিকে বজায় রেখে চলেন। “চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে প্রদত্ত রিপোর্ট” (৫ মার্চ, ১৯৪৯)

*** কঠোর সংগ্রাম ছাড়া, ঘাম ও রক্তপাত ছাড়া সৌভাগ্যবশত সহজে বিজয় লাভের যে সমস্ত ধারণা আমাদের কেডারদের মধ্যে রয়েছে তা অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে সাফ করে ফেলতে হবে। “উত্তর-পূর্বে সুদৃঢ় ঘাঁটি এলাকা গড়ে তুলুন” (২৮ ডিসেম্বর, ১৯৪৫)

*** আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্ব-অগ্রগতির অবস্থা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জনগণের মধ্যে সর্বদা প্রচার চালাতে হবে, যাতে বিজয়ের উপর জনগণ আস্থা স্থাপন করতে পারেন। একই সময়ে জনগণ এবং কমরেডদেরকে আমাদের বলে দিতে হবে যে, এই পথ হচ্ছে আঁকাবাঁকা। বিপ্লবের পথে আরও অনেক বাধা-বিঘ্ন ও দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। আমাদের পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে অনুমান করা হয়েছিল যে, আমাদের অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে, কারণ আমরা বাধা-বিপত্তিকে আরও বেশি করে ভাবতে পছন্দ করি। আমাদের কোনো কোনো কমরেড কষ্টকে বেশি করে ভাবতে চান না। কিন্তু কষ্টটা হচ্ছে বাস্তব, কষ্ট যতই থাক, ততই তা স্বীকার করতে হবে, ‘অস্বীকারের নীতি’ অবলম্বন করলে চলবে না। আমাদের কষ্টকে স্বীকার করতে হবে, তার বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে। পৃথিবীতে কোথাও সোজা পথ নেই, আঁকাবাঁকা পথে চলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, কখনও সস্তায় কোনো কিছু লাভের চেষ্টা করা উচিত নয়। এটা মনে করা উচিত নয় যে, কোনো এক সুন্দর ভোরে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা স্বেচ্ছায় হাঁটু গেড়ে বসবে। এক কথায়, আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, কিন্তু পথটা আঁকাবাঁকা। আমাদের সামনে বহু বাধা-বিপত্তি রয়েছে, যা আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়। আমরা সমগ্র জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমবেত প্রচেষ্টায় অবশ্যই সমস্ত বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করতে ও বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হবো। “ছুংছিং আলাপ-আলোচনা সম্পর্কে” (১৭ অক্টোবর, ১৯৪৫)

আরো পড়ুন:  অধ্যয়ন

*** যারা শুধুমাত্র উজ্জ্বল দিকটা দেখেন, কষ্টকর দিকটা দেখেন না, তাঁরা পার্টির কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সংগ্রাম করতে পারেন না। “যুক্ত সরকার সম্পর্কে” (২৪ এপ্রিল, ১৯৪৫)

*** সমাজের সম্পদকে শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী বুদ্ধিজীবীরাই সৃষ্টি করেন। যদি তাঁরা নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে নেন, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী লাইন অনুসরণ করেন, সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে নয় বরং সক্রিয় মনোভাব নিয়ে তা সমাধান করেন, তাহলে পৃথিবীর যে কোনো বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করতে পারবেন। “পার্টি সম্পাদক কাজে হাত লাগান, সমগ্র পার্টি সমবায় সমিতি গঠনের কাজ করে”-এর ভূমিকালিপি (১৯৫৫)

*** গোটা পার্টির কমরেডদের অবশ্যই এসব কিছু পরিপূর্ণভাবে বিবেচনা করতে হবে এবং অদম্য মনোবলের সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও আমাদের উভয়ের সামনেই বাধা-বিপত্তি রয়েছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করা অসম্ভব। কারণ, তারা মৃতপ্রায়, তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করা যেতে পারে, কারণ আমরা নবপ্রকাশমান শক্তি, আর আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। “চীনা বিপ্লবের নতুন উত্তাল জোয়ারকে স্বাগত জানান” (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭)

*** আমাদের কমরেডদের কষ্টের সময়ে অবশ্যই সাফল্য ও ঔজ্জ্বল্যকে দেখতে হবে এবং আমাদের সাহস বাড়াতে হবে। জনগণের সেবা করুন” (৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪)

*** যে কোনো নতুন জিনিসকে বিকাশের সময়ে সর্বদাই বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং এঁকেবেঁকে চলতে হয়। বাধা-বিপত্তি ও আঁকাবাঁকা পথ ছাড়া এবং খুব বিরাট প্রচেষ্টা ছাড়া, সমাজতান্ত্রিক কার্যে সর্বদাই পালের অনুকূল বাতাসে অগ্রসর হবার মতো সহজে সাফল্য লাভ করা যায় এমন মনে করাটা শুধু কল্পনামাত্র। “জনগণের ভেতরকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসার সমস্যা সম্পর্কে” (২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭)

*** বিপ্লবী সংগ্রামে কোনো কোনো সময়ে অনুকূল অবস্থার থেকে বাধা-বিপত্তিই বেশি জোরদার হয়ে উঠে, এই সময়ে বাধা-বিপত্তি হচ্ছে দ্বন্দ্বের প্রধান দিক, অনুকূল অবস্থা হচ্ছে গৌণ দিক। কিন্তু বিপ্লবীদের প্রয়াসের মাধ্যমে বাধা-বিপত্তিকে ধাপে ধাপে অতিক্রম করা সম্ভব, নতুন অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করাও সম্ভব, এমনি করে প্রতিকূল অবস্থা অনুকূল অবস্থার জন্য স্থান ছেড়ে দেয়। দ্বন্দ্ব সম্পর্কে” (আগস্ট, ১৯৩৭)

আরো পড়ুন:  ভারতে অভ্যুত্থান

*** কাজ কাকে বলে? কাজই হচ্ছে সংগ্রাম। ঐ সব স্থানে রয়েছে বাধা-বিপত্তি আর সমস্যা, সেগুলোকে আমাদের সমাধান করতে হবে। আমরা বাধা-বিপত্তিগুলোকে সমাধান করার জন্যই সেখানে কাজ করতে ও সংগ্রাম করতে যাই। যেখানে যত বেশি বাধা-বিপত্তি সেখানে যেতে ততই বেশি আগ্রহশীল, শুধু এই ধরনের লোকই হচ্ছেন ভাল কমরেড। “ছুংছিং আলাপ-আলোচনা সম্পর্কে” (১৭ অক্টোবর, ১৯৪৫)

*** একটা প্রাচীন চীনা উপকথা আছে, তার নাম ‘বোকা বুড়ো পাহাড় সরিয়েছিলেন’। এ উপকথায় প্রাচীন কালের এক বুড়োর কাহিনী বলা হয়েছে, তিনি বাস করতেন উত্তর চীনে। উত্তর পাহাড়ের বোকা বুড়ো নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর বাড়িটার দক্ষিণে ছিল দুটি উচ্চ পাহাড়, একটার নাম থাইহাং, অন্যটার নাম ওয়াংউ। এই দুটি পাহাড় তার বাইরে যাবার পথ রুখে দাঁড়িয়েছিল। তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে এই পাহাড় দুটিকে কোদাল দিয়ে খুঁড়ে উপড়ে ফেলবার জন্য তাঁর ছেলেদের নিয়ে গেলেন। আর একজন বুড়ো, জ্ঞানী নামে তিনি পরিচিত এদের দেখে উপহাস করে বললেন, “তোমরা কী বোকার মতোই না কাজ করছো! এই বিরাট পাহাড় দুটিকে খুঁড়ে উপড়ে ফেলা তোমাদের পিতাপুত্র ক’জনের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।” বোকা বুড়ো জবাব দিলেন, “আমি মরলে আমার ছেলেরা এ কাজ চালিয়ে যাবে, তারা যখন মরবে তখন থাকবে আমার নাতিরা, আর তার পরে তাদের ছেলেরা ও নাতিরা। এমনি চলবে অনন্ত কাল ধরে। পাহাড় দুটি অনেক উঁচু, কিন্তু আর তারা উঁচু হতে পারবে না। আমরা যতটুকু খুঁড়ে ফেলব, ততটুকুই তারা নীচু হবে। তাহলে কেন আমারা তাদের খুঁড়ে সমান করতে পারবো না?” জ্ঞানী বুড়োর ভুল অভিমতটা খণ্ডন করে তিনি অবিচল বিশ্বাসের সাথে প্রতিদিন খুঁড়তে থাকলেন। এই দেখে ভগবান মুগ্ধ হলেন, তিনি দুজন দেবদূতকে পৃথিবীতে অবতরণ করালেন। তাঁরা এসে পাহাড় দুটিকে পিঠে করে নিয়ে চলে গেলেন। আজ চীনা জনগণের মাথার উপরেও দুটি প্রকাণ্ড পাহাড় চেপে আছে। একটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, আর অন্যটা সামন্তবাদ। এ দুটিকে খুঁড়ে উপড়ে ফেলার জন্য অনেকদিন আগেই মনস্থির করেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। আমাদের অবশ্যই অধ্যবসায়ী হতে হবে এবং কাজ করতে হবে বিরামহীনভাবে, আমরাও তখন ভগবানের মন গলাতে পারবো। আমাদের ভগবান কিন্তু চীনা জনসাধারণ ছাড়া আর কেউ নন। তাঁরা যদি একযোগে উঠে দাঁড়ান এবং আমাদের সঙ্গে মিলে খুঁড়তে থাকেন, তাহলে এই দুটি পাহাড়কে উপড়ে ফেলা যাবে না কেন? যে বোকা বুড়ো পাহাড় সরিয়েছিলেন” (১১ জুন, ১৯৪৫)

আরো পড়ুন:  সংস্কৃতি ও শিল্পকলা

Leave a Comment

error: Content is protected !!