সভাপতি মাও সেতুংয়ের কয়েকটি রাজনৈতিক-সামরিক উদ্ধৃতি

সভাপতি মাও সেতুংয়ের প্রায় পনেরটি রাজনীতি বিষয়ক উদ্ধৃতি পাঠকের জন্য এখানে নেয়া হলও। এই রাজনৈতিক উদ্ধৃতিগুলো পড়ে রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষণ সম্পর্কে চেয়ারম্যান মাওয়ের চিন্তাধারা পাওয়া যাবে। — সম্পাদক।

০১. বিষয়ীবাদ, সংকীর্ণতাবাদ ও ছকে বাঁধা পার্টিগত রচনা — এই তিনটিই মার্কসবাদবিরোধি এবং এইগুলি শ্রমিকশ্রেণির নয়, শোষক শ্রেণিসমূহেরই স্বার্থসাধন করে। ছকে বাধা পার্টিগত রচনার বিরোধিতা করুন; ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২

০২. নির্ভুল সর্বদাই ভুলের সঙ্গে সংগ্রাম করে বিকশিত হয়। সত্য, মঙ্গল ও সুন্দর সব সময়ই মিথ্যা, অমঙ্গল ও কুৎসিতের সঙ্গে তুলনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়, এবং সেগুলোর সঙ্গে সংগ্রাম করে প্রসার লাভ করে। মানবসমাজ যখনই কোনো অসত্যকে নাকচ করে দিয়ে কোনো একটা সত্যকে স্বীকার করে নেয় তখনই নতুন সত্য আবার নতুন মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ করে। এই সংগ্রাম কোনোদিনই শেষ হবে না। “জনগণের ভেতরকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসার সমস্যা সম্পর্কে”, (২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭)

০৩. দুনিয়ার সব জিনিসের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে মূল্যবান। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যতদিন জনগণ থাকবেন ততদিন যে কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটিয়ে দেয়া যাবে।… বিপ্লব সব কিছু পালটে দিতে পারে। “ইতিহাসের ভাববাদি ধারণার দেউলিয়াপনা থেকে” (১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯)

০৫. কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত সামরিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য চেষ্টা করেন না …, কিন্তু পার্টির জন্য সামরিক ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে ও জনগণের জন্য সামরিক ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে তাঁদের চেষ্টা করা উচিত। … সামরিক ক্ষমতার প্রশ্নে শিশুসুলভ ব্যাধি থাকলে নিশ্চয় কোনো কিছুই অর্জন করতে পারা যায় না। মেহনতি জনগণ, যাঁরা হাজার হাজার বছর ধরে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণির দ্বারা প্রবঞ্চিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত, তাঁদের পক্ষে নিজেদের হাতে বন্দুক তুলে নেবার গুরুত্বটা উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। … প্রতিটি কমিউনিস্টকে অবশ্যই এ সত্য বুঝতে হবেঃ ‘বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে’। আমাদের নীতি হচ্ছে _ পার্টি বন্দুককে পরিচালনা করে, বন্দুককে কোনোমতেই পার্টির ওপর পরিচালনা করতে দেয়া হবে না।… … যুদ্ধ বিলোপ করার আমরা সমর্থক, আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু কেবলমাত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই যুদ্ধ বিলোপ করা যায় এবং বন্দুক থেকে মুক্তি পাবার জন্য বন্দুক ধারণ করা অবশ্য প্রয়োজন। ‘যুদ্ধ ও রণনীতির সমস্যা’, ৬ নভেম্বর, ১৯৩৮

আরো পড়ুন:  যুবক
মানুষই সবচেয়ে মূল্যবান। — মাও সেতুং

০৬. মতান্ধতাবাদ ও সংশোধনবাদ উভয়ই মার্কসবাদের পরিপন্থী। মার্কসবাদ অবশ্যই এগিয়ে যাবে, অনুশীলনের বিকাশের সংগে সংগে অবশ্যই বিকাশ লাভ করবে, এটা অচল থাকতে পারে না। নিশ্চল ও অপরিবর্তিত থাকলে এটা হয়ে পড়বে প্রাণহীন। কিন্তু মার্কসবাদের মৌলিক নীতিকে অবশ্যই লঙ্ঘন করা চলবে না, অন্যথায়, ভুল করা হবে। আধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ দিয়ে মার্কসবাদকে দেখা এবং এটাকে অনড়-অটল কিছু একটা বলে ভাবাই হচ্ছে মতান্ধতাবাদ। ‘প্রচারকার্য সম্পর্কে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ’, ১২ মার্চ, ১৯৫৭

০৭. আমি যখন ছাত্র ছিলাম, আমার ধারনা ছিল বুদ্ধিজীবিরাই সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, চাষী-মজুররা অপরিস্কার। পরে বিপ্লবী সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, আমি আগে পেটিবুর্জোয়া মানসিকতার শিকার ছিলাম। আসলে মধ্যবিত্ত, পেটিবুর্জোয়া বুদ্ধিজীবিদের মনটা পরিস্কার নয়, অনেক ভন্ডামি আছে, এরা মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। শ্রমিক-চাষী, যাদের পায়ে গোবর, হাতে কাদা-মাটি, ময়লা ছিন্ন পোষাক, তারাই মনের দিক দিয়ে মানুষ হিসেবে অনেক বেশি পরিস্কার।

০৮. গুণগত বিভিন্ন দ্বন্দ্বগুলোকে কেবলমাত্র গুণগত বিভিন্ন পদ্ধতির দ্বারাই সমাধান করা যেতে পারে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, সর্বহারা শ্রেণীর ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পদ্ধতির দ্বারা মীমাংসা করা হয়; ব্যাপক জনসাধারণ ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যকার দ্বন্দ্ব গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পদ্ধতির দ্বারা মীমাংসা করা হয়; উপনিবেশগুলোর ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব জাতীয় বিপ্লবী যুদ্ধের পদ্ধতির দ্বারা মীমাংসা করা হয়; সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক শ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব কৃষির যৌথকরণ ও যান্ত্রিকীকরণের পদ্ধতির দ্বারা সমাধান করা হয়; কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরকার দ্বন্দ্ব সমালোচনা ও আত্নসমালোচনার পদ্ধতির দ্বারা মীমাংসা করা হয়; সমাজের ও প্রকৃতির মধ্যকার দ্বন্দ্ব উত্‍পাদন-শক্তির বিকাশ সাধনের দ্বারা মীমাংসা করা হয়। . . . . . . . বিভিন্ন দ্বন্দ্বের মীমাংসার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে এমন একটা মূলনীতি, যা মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের অবশ্যই কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে, আগস্ট ১৯৩৭

আরো পড়ুন:  অধ্যবসায় ও মিতব্যয়িতার সঙ্গে দেশ গঠন

০৯. আমরা স্বীকার করি যে, সাধারণ ঐতিহাসিক বিকাশে বস্তুগত জিনিস মানসিকতাকে নির্ধারণ করে, সামাজিক অস্তিত্ব সামাজিক চেতনাকে নির্ধারণ করে; কিন্তু একই সময়ে আমরা স্বীকার করি এবং আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে মানসিকতার প্রতিক্রয়াকে, সামাজিক অস্তিত্বের উপর সামাজিক চেতনার প্রতিক্রিয়াকে এবং অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপর উপরি-কাঠামোর প্রতিক্রিয়াকে। এটা বস্তুবাদকে লংঘন করে না, অপরপক্ষে যান্ত্রিক বস্তুবাদকে এড়িয়ে যায় এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে রাখে। দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে, আগস্ট ১৯৩৭

১০. যথাসাধ্য অহংকার পরিহার করুন। নেতৃস্থানীয় লোকের পক্ষে এটা হচ্ছে নীতিগত সমস্যা এবং ঐক্য বজায় রাখার গুরুত্বপূর্ণ শর্তও। গুরুতর ভূল যাঁরা করেন নি, বরং নিজেদের কাজে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছেন, তাঁদেরও অহংকার করা উচিত নয়।

১১. সর্বহারা শ্রেণির পক্ষে দুনিয়াকে জানার উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র দুনিয়াকে রূপান্তর করা, এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নাই। মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে, মে ১৯৬৩

১২. বিপুল বিশৃংখলার পর বিশাল শৃংখলা আসে। এবং এটা প্রতি সাত বা আট বছর পর পরই হবে। দৈত্য ও দানবেরা লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে। তাদের শ্রেণি চরিত্র দ্বারা চালিত হয়ে তারা বেরিয়ে আসতে বাধ্য। দশম পার্টি কংগ্রেসের দলিলে উদ্ধৃত (১৯৬৬)

১৩. বেশ কিছু সংখ্যক লোক নিজেদের কাজে দায়িত্বজ্ঞানহীন। তাঁরা ভারীটা ভয় করেন, হাল্কাটা গ্রহণ করেন। ভারী ভারগুলো অন্যদের কাঁধে ঠেলে দেন, নিজেরা হাল্কাটা বহন করেন। যদি তাঁদের সামনে কোনো কাজ পড়ে, তাহলে প্রথমে তাঁরা নিজেদের কথা ভাবেন, তারপর অন্যদের। সামান্য একটা কাজ করলেই তাঁরা আত্ম-অহমিকায় মেতে উঠেন। নিজেদের বড়াই করতে তাঁরা ভালোবাসেন। তাঁরা এই ভয় করেন যে, তাঁদের কাজ সম্পর্কে হয়তো অপরে জানতে পারবে না। তাঁরা কমরেড ও জনগণের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করেন না, বরং নিরুত্তাপ, যত্নহীন ও নির্দয় ব্যবহার করেন। আসলে, এই ধরনের লোক কমিউনিস্ট নন, অন্ততপক্ষে তাঁদের কমিউনিস্ট বলে ধরা যায় না। ২১ ডিসেম্বর, ১৯৩৯

আরো পড়ুন:  কমিউনিস্ট
বিজয় অবধি সংগ্রাম করাই জনগণের নিয়ম। — মাও সেতুং

১৪. গোলযোগের সৃষ্টি করা, ব্যর্থ হওয়া, আবার গোলযোগের সৃষ্টি করা, আবার ব্যর্থ হওয়া, সর্বনাশের আগ পর্যন্ত_ এটাই হচ্ছে জনগণের কার্যের প্রতি সাম্রাজ্যবাদিদের এবং বিশ্বের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের যুক্তি এবং কোনো দিনই তারা এ যুক্তি লঙ্ঘন করবে না। এটাই হচ্ছে একটা মার্কসবাদী নিয়ম। যখন আমরা বলি, “সাম্রাজ্যবাদ খুবই হিংস্র” তখন আমরা অর্থ করি যে, ওদের স্বভাব কখনো বদলাবে না, সাম্রাজ্যবাদিরা নিজদের ধ্বংস অবধি তাদের কসাইয়ের ছুরি কখনো ছাড়বে না, কখনো তারা বুদ্ধদেব হবে না।

সংগ্রাম করা, ব্যর্থ হওয়া, আবার সংগ্রাম করা, আবার ব্যর্থ হওয়া, আবার সংগ্রাম করা, বিজয় অবধি_ এটাই হচ্ছে জনগণের যুক্তি, তাঁরাও কখনো এই যুক্তি লঙ্ঘন করবেন না। এটা আর একটা মার্কসবাদি নিয়ম। রাশিয়ার জনগণের বিপ্লব এই নিয়ম অনুসরণ করেছিল, চিনা জনগণের বিপ্লবও তাই করছে। ‘ভ্রম ত্যাগ করো, সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হও’, ১৪ আগস্ট, ১৯৪৯

Leave a Comment

error: Content is protected !!