চে গ্যেভারা, (Che Guevara) বা এর্নেস্তো গ্যেভারা দে লা সের্না (স্পেনীয় ভাষায় Ernesto Guevara de la Serna) (জুন ১৪, ১৯২৮-অক্টোবর ৯, ১৯৬৭) বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতিমান বিপ্লবীদের অন্যতম। তিনি পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন এবং ফিদেল কাস্ত্রোর দলে প্রথমে দলের চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি অনুকরণীয় এক বিপ্লবীতে পরিণত হন। এখানে চে গ্যেভারা ৩০টি উদ্ধৃতি প্রদান করা হলো।
১. আমি মুক্তিদাতা নই, মুক্তিদাতাদের অস্তিত্ব নেই। জনগণই নিজেদের মুক্ত করেন। মেক্সিকোতে বিবৃতি (১৯৫৮); as quoted in Kaplan AP World History 2005 (2004) edited by the Kaplan staff, p. 240
২. বিপ্লব একটি আপেল নয় যে পাকার পরে পড়বে। আপনাকেই এটা পাড়তে হবে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্রেস (খণ্ড ৩ জানুয়ারি-এপ্রিল ১৯৬৫) এছাড়াও, in Che Guevara speaks: Selected Speeches and Writings (1967)
৩. পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটির সমস্ত সম্পদের চেয়েও ১০ লক্ষ গুণ অধিক মূল্যবান একজন মানুষের জীবন। “On Revolutionary Medicine”, speech delivered to the Cuban Militia (16 August 1960).
৪. বিপ্লবের পথে কেউ জয়ী হতে পারে বা মারা যেতে পারে, যদি বিপ্লব হয় প্রকৃতই বিপ্লব। “Farewell letter from Che to Fidel Castro” Original Spanish text (published 1 April 1965)
৫. ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমার প্রিয় এম-২ রাইফেলটা অকেজো হয়ে গেছে। তবে আমার পরাজয় এই নয় যে, বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। এভারেস্ট বিজয়ের অভিযানেও অনেকে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা আজ মানুষ জয় করেছে। ফিদেলকে বলো— আমার মৃত্যুতে বিপ্লব পরাজিত হয়নি। বিপ্লবের মৃত্যু নেই। শোষিত মানুষের জয় অনিবার্য।
৬. আমাদের সামনে এখন পড়ে রয়েছে দীর্ঘ পথ। একটি প্রকৃষ্ট সমাজ, যে সমাজ হবে শ্রেণিহীন, সমস্ত রকমের বৈষম্য যে সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যাবে, সেই সমাজ প্রতিষ্ঠা করা পর্যন্ত সেই পথ লড়াই আর নিরানন্দে ভরা থাকবে।
৭. আমি বিশ্বাস করি – নিজেদের মুক্তির জন্য যারা লড়াই করতে চায়, সশস্ত্র সংগ্রামই তাদের একমাত্র পথ। এ বিশ্বাসে আমি অবিচল। অনেকে হয়তো আমাকে অ্যাডভেঞ্চারার বলবে। হ্যা, সত্যিই আমি অ্যাডভেঞ্চারার, শুধু একটু অন্য ধরনের — আমি হচ্ছি সেই অ্যাডভেঞ্চারারদের একজন, যারা নিজেদের অঙ্গীকারের প্রমান দিতে বাজি রাখে খোদ জীবনটাকেই।
৮. একজন মানুষ কর্তৃক অন্য মানুষের উপর যে শোষণ এটা রোধ করা ছাড়া আমাদের কাছে সমাজতন্ত্রের অন্য কোনো ব্যাখ্যাই বৈধ নয়।
৯. স্বাধীনতা তখনই অর্জন করা হয় যখন মানুষের উপর থেকে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব শেষ করা যায়।
১০. হাস্যকর লাগার একটি ঝুঁকি নিয়েই বলতে চাই যে, একজন সত্যিকার বিপ্লবী পরিচালিত হয় একটি গভীর ভালবাসা থেকে। এটা চিন্তা করাও অসম্ভব যে এই গুণটি ছাড়া কেউ প্রকৃত বিপ্লবী হতে পারে।
১১. জগতের অন্য কোথাও কি হচ্ছে তা থেকে আমরা আলাদা হতে পারি না, কারণ সাম্রাজ্যবাদের উপর যে কোনো দেশের বিজয় হল আমাদের বিজয় একইভাবে যে কোনো দেশের পরাজয় আমাদের সবার পরাজয়।
১২. নতুন নেতাদের নিষ্ঠুর হয়ে ওঠার মাধ্যমেই কেবল নিষ্ঠুর নেতাদের অপসারণ সম্ভব।
১৩. অনেকে বলে আমি একজন অভিযাত্রী – এবং আমি আসলেই তাই, শুধু একটু অন্য ধরনের। আমি তাদের একজন যারা কিনা নিজের সামান্য একটি কথা প্রমাণ করার জন্য নিজের চামড়াটা বাজি রাখে।
১৪. জয়ের আগ পর্যন্ত লড়াই, সবসময়। “Farewell letter from Che to Fidel Castro” Original Spanish text (published 1 April 1965)
১৫. আমরা কিসের জন্য বাঁচব সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যতক্ষণ না আমরা তার জন্য মরতে প্রস্তুত থাকি।
১৬. তুমি যদি প্রতিটি অবিচারের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠ, তাহলে তুমি আমার একজন সহযোদ্ধা।
১৭. গেরিলা যোদ্ধারা কেন যুদ্ধ করে? শেষ পর্যন্ত অনিবার্যভাবেই আমাদের বুঝতে হবে যে গেরিলা যোদ্ধা হচ্ছে একজন সমাজ সংগঠক, যে অস্ত্র তুলে নেয় নিপীড়ক শাসকের বিরুদ্ধে জনতার হয়ে উত্তর দেবার জন্য, এবং সে যুদ্ধ করে সেই সমাজব্যাবস্থার বিরুদ্ধে যা তার অস্ত্রহীন ভাইদের অবমাননা ও দুর্দশার ভেতরে রাখে। গেরিলা যুদ্ধ প্রসঙ্গে, (১৯৬০), অধ্যায় ১।
১৮. আমার পরাজয়ের অর্থ এই নয় যে, বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়। এভারেস্ট বিজয়ের অভিযানেও অনেকে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা আজ মানুষ জয় করেছে। ফিদেলকে বলো- আমার মৃত্যুতে বিপ্লব পরাজিত হয়নি, বিপ্লবের মৃত্যু নেই। শোষিত মানুষের জয় অনিবার্য। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ একদিন ধ্বংস হবেই। বিদায়।
১৯. আমি জানি তোমরা আমাকে গুলি করে মারবে। আমি জীবিতাবস্থায় বেরুতে পারবো না। ফিদেলকে বলো এই পরাজয় বিপ্লবের শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বিপ্লবের বিজয় হবেই। সালেইদাকে (চের স্ত্রী) বলো ব্যাপারটি ভুলে যেতে, সুখী হতে বলো, বাচ্চাদের লেখাপড়ার ব্যাঘাত না ঘটে, আর সৈন্যদেরকে বলো, যেন আমার দিকে ঠিকভাবে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। —মৃত্যুর আগে।
২০. পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলুন। সমাজের কালো, মিশ্রবর্ণ, শ্রমিক ও কৃষকের কাতারে নিজেদের শামিল করুন। দেশের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের সঙ্গেই আপনাদের বাঁচতে হবে, একই বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে হবে। ১৯৫৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব লাস ভিয়াসের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে চে।
২১. যখন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংসের ছক কাটা হয়, তখন এটার মাথাটা খুঁজে পাওয়া দরকারি হয়ে পড়ে, যেটা ইউনাইটেড স্টেটস্ অফ আমেরিকা ছাড়া আর কিছুই না।
২২. যে কথার কাজের সাথে মিল নেই তা অপ্রয়োজনীয়।
২৩. আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক একটি সিংহনাদ এবং সাধারণ মানুষের ঐক্যের জন্য একটি যুদ্ধ-বন্দনা, তাদের বিরুদ্ধে যারা মানবতার প্রধান শত্রু ইউনাইটেড স্টেটস্ অফ আমেরিকা। যেখানেই মৃত্যু এসে আমাদের বিস্মিত করে, তাকে স্বাগত জানাও যেন আমাদের সিংহনাদ কোন গ্রহণোন্মুখ কানে পৌঁছায় এবং আমাদের অস্ত্র গ্রহণ করার জন্য আর একটি হাত প্রসারিত হয়। এবং অন্যরা যেন প্রস্তুত হয় মেশিনগানের শব্দে এবং যুদ্ধ ও বিজয়ের নতুন সিংহনাদ তুলে আমাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার গান গাওয়ার জন্য।
২৪. একজন গেরিলার এলাকার সব লোকের কাছ থেকে পূর্ণ সাহায্য দরকার হয়। এটি একটি অপরিহার্য শর্ত। গেরিলা যুদ্ধ প্রসঙ্গে, (১৯৬০), অধ্যায় ১।
২৫. একটি বিপ্লবে একজন অর্জন করে – বিজয় অথবা মৃত্যু। ফিদেলকে শেষ চিঠি, ১লা এপ্রিল, ১৯৬৫
২৬. মানুষের কাছে পৌঁছতে হলে মানুষের সংগে মিশে যেতে হবে। তোমাদের জানতে হবে জনগণ কি চায়, তাদের কি প্রয়োজন, তারা কেমন আছে, কি ভাবছে। ১৯৫৯ সালে লাসভিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে
২৭. বিশ্ববিদ্যালয় হবে গণমানুষের। মনে রাখতে হবে, এই বিশ্ববিদ্যালয় কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়, এটি কিউবার জনগণের সম্পত্তি। বিজয় হলে কেবল জনগণেরই হবে। জনগণ এখন জানে যে তারা অপ্রতিরোধ্য। আজ তারা আশায় বুক বেঁধে এদিকে তাকিয়ে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়কেই আভিজাত্যের মুখোশ খুলে তাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাতে হবে। হয় আপামর জনসাধারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার খুলে দাও, নয়তো শুধু দুয়ার খোলো; জনগণই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের মতো করে গড়ে নেবে। ১৯৫৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব লাস ভিয়াসের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে চে
২৮. তোমার বাবা ছিল এমন একজন মানুষ ছিল যে তার মতে যেটা সেরা সেটাই করতে চেষ্টা করেছে, এবং যে তার সেই বিশ্বাসে অবিচল ছিল। সন্তানদের কাছে লেখা শেষ চিঠিতে চে।
২৯. ভাল একজন বিপ্লবী হয়ে ওঠো। দক্ষতা অর্জন করার জন্য কঠোর পড়াশুনা করো, যেটা তোমাদের স্বভাবের উপর কর্তৃত্ব দান করবে। মনে রাখবে যে বিপ্লবটাই প্রয়োজনীয় এবং আমরা প্রত্যেকে, আলাদা আলাদা ভাবে কিছুই নই। সন্তানদের কাছে লেখা শেষ চিঠিতে চে।
৩০. সবার আগে, পৃথিবীর যে কোন জায়গায়, যে কারো বিরুদ্ধে, যে কোন অবিচার গভীরভাবে অনুভব করার জন্য সবসময় নিজেকে প্রস্তুত রাখবে। এটা একজন বিপ্লবীর সবচেয়ে সুন্দর একটি গুণ। চে, সন্তানদের কাছে শেষ চিঠি
আরো পড়ুন অনুপ সাদির প্রবন্ধ:
১. চে গ্যেভারা ফোকো মতবাদের অনুসারী এক গেরিলা বিপ্লবী
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।