পুঁজিবাদ আনুষ্ঠানিক সমান অধিকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও তার ফলে, সামাজিক অসাম্য মিশ্রিত করে। পুঁজিবাদের এই অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যকে বুর্জোয়ার সমর্থকরা ও উদারনীতিকরা আড়াল দিয়ে থাকে এবং ক্ষুদে বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা তা বুঝতেই পারে না। পুঁজিবাদের এই বৈশিষ্ট্যবশত অর্থনৈতিক সাম্যের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞভাবে সংগ্রাম চালাবার সময় পুঁজিবাদী অসাম্য প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেওয়ার প্রয়োজন উপস্থিত হয় এবং কোন কোন অবস্থায় শ্রমিক রাষ্ট্রের ভিত্তি (সোভিয়েত রাষ্ট্র কাঠামো) স্থাপনের জন্য এইরূপ খোলাখুলিভাবে অসাম্যের কথা ঘোষণা করা কার্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
পুঁজিবাদ কিন্তু সামঞ্জস্যর সঙ্গে, এমনকি, মামুলি সমান অধিকারও (আইনের চোখে সমান অধিকার, অতিপুষ্ট ও ক্ষুধার্ত, সম্পত্তির মালিক ও বিত্তহীনের মধ্যে সমান অধিকার) মেনে নিতে পারে না। পুরুষের তুলনায় মেয়েদের অবনত অবস্থা এই অসামঞ্জস্যের একটা জ্বলন্ত প্রমাণ। একটিমাত্র বুর্জোয়া রাষ্ট্রও এমন কি সবচেয়ে প্রগতিশীল, রিপাবলিকান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও নরনারীর পুরোপুরি সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। কিন্তু রুশিয়ার সোভিয়েত রিপাবলিক মেয়েদের আইনগত মর্যাদার ভেতরে যে সমস্ত অসাম্য ছিল, একাদিক্রমে তার শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত বিলুপ্ত করে আইন কানুনের ক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য পূর্ণ সমান অধিকারের ব্যবস্থা করেছে।
কথিত আছে যে সভ্যতার মাপকাঠি কতটুকু উচ্চ তার প্রকৃষ্টতম পরিচয় পাওয়া যায় মেয়েদের আইনগত মর্যাদার ভেতরে। এই উক্তির মধ্যে গভীর সত্য কথা নিহিত রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে, কেবলমাত্র শ্রমিকদের একনায়কত্ব, কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র উচ্চতর সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারতো এবং করেছেও।
কাজেই প্রথম সোভিয়েত রিপাবলিকের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা (এবং তার শক্তিবৃদ্ধি) এবং এর সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক– শ্রমিক নারীদের আন্দোলনে অবশ্যম্ভাবীরূপে নতুন, অতুলনীয় ও শক্তিশালী ইন্ধন জুগিয়েছে।
কারণ পুঁজিবাদের আমলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, পুরোপুরি বা আংশিকভাবে যারা নিগৃহীত হয়েছিল, তাদের নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন আমরা বেশ বুঝতে পারি যে, একমাত্র সোভিয়েট ব্যবস্থা, সঠিকভাবে, সোভিয়েট সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাই গণতন্ত্র স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণী ও দরিদ্র কৃষিজীবীদের অবস্থার মধ্যে এর প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। সুস্পষ্ট পরিচয় আরও পাওয়া যায় মেয়েদের অবস্থার মধ্যে।
সোভিয়েত ব্যবস্থা কিন্তু শ্রেণীসমূহের বিলোপ সাধন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য স্থাপনের জন্য চরম সংগ্রামরূপেই গণ্য। আমাদের পক্ষে গণতন্ত্র, এমন কি, নির্যাতিতা নারী জাতির গণতন্ত্রসহ পুঁজিবাদের আমলে নির্যাতিতদের গণতন্ত্রও পর্যাপ্ত নয়।
কেবলমাত্র মেয়েদের মামুলি সমান অধিকার নিয়ে নয়, মেয়েদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমান অধিকারের জন্য সংগ্রামই শ্রমিক নারী আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। প্রধান কর্তব্য হচ্ছে, মেয়েদের পারিবারিক গোলামি, রান্নাঘর ও শিশু রক্ষণাগারের চিরন্তনী বদ্ধ ও অবমাননাকর গা ঢেলে দেওয়া থেকে মুক্ত করে তাদের সামাজিক বড় বড় উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করতে হবে। সমাজের গড়ন ও সামাজিক রীতিনীতির আমূল পরিবর্তন সাধনের জন্য দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম পরিচালনার প্রয়োজন। এই সংগ্রামের শেষে কম্যুনিজমের পূর্ণ জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী।
প্রাভদা, ৪ মার্চ, ১৯২০
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।