ব্যর্থ রাষ্ট্র হচ্ছে কেন্দ্রীভূত সামরিক কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ রাষ্ট্র

“রাষ্ট্র হলো একটি শ্রেণীর হাতে অপর শ্রেণীর ওপর আধিপত্য কায়েম করার যন্ত্র, অধীনস্থ শ্রেণীগুলোকে আনুগত্যের বন্ধনে রাখার হাতিয়ার।”[১] লেনিন এই যে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন যা এমনই এক সত্যকে ধারণ করছে যাকে কেবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন বুর্জোয়া মূর্খরাই বিরোধীতা করে।

এঙ্গেলসের ধ্রুপদী বই ‘পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি‘ আর লেনিনের বই ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এর সারমর্ম মাথায় থাকলে কী কোনো রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদ কথিত ব্যর্থ রাষ্ট্র (ইংরেজি: Failed State) মনে হবে?
যেসব রাষ্ট্রকে ব্যর্থ বলছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো, সেগুলো আসলে রাষ্ট্র হিসেবে কর্তৃত্বের কেন্দ্রে নেই। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সোমালিয়া, নাইজেরিয়াসহ এই ধরনের ভঙ্গুর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা পাওয়া রাষ্ট্রগুলোতে গণনির্যাতন বরং বেশি। মূলত “যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি ২০০৫ সাল থেকে প্রতিবছর ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সূচক (ইংরেজি: Fragile State Index) তৈরি করে আসছে,[২] এবং তখন থেকেই ব্যর্থ ও ভঙ্গুর রাষ্ট্র কথাটি চালু হয়েছে।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে আলো ফেললেই আমরা দেখবো, রাষ্ট্রের কাজই হচ্ছে অধীনস্থ শ্রেণিগুলোর উপর নির্যাতন, নিপীড়ন আর গণহত্যা চালানো। ঐতিহাসিক কাল থেকেই রাষ্ট্র হচ্ছে শোষক শ্রেণির নিজস্ব ব্যবস্থাপনা। সেই অর্থে রাষ্ট্র হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা যা শোষক শ্রেণির নিয়ন্ত্রিত নিজস্ব শক্তিকেন্দ্র।[৩]

নিপীড়নের ক্ষেত্রে এইসব ভঙ্গুর রাষ্ট্র বা প্রযুক্তি ও সম্পত্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে ফারাক সামান্যই আছে। “দাস সমাজে আদিম যুগের গদাই হোক বা মধ্যযুগে আবিষ্কৃত আগ্নেয়াস্ত্রই হোক বা উনিশ শতকে আবিষ্কৃত অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি আধুনিকতম অস্ত্রই হোক এই রাষ্ট্রযন্ত্রটি অথবা প্রশাসকেরা সর্বদাই একটা উৎপীড়নের যন্ত্র, বা দানবিক শক্তিতে সজ্জিত থাকে। নির্যাতনের অস্ত্রটা বদলাতে পারে কিন্তু যতদিন রাষ্ট্র থাকবে, হুকুম জারি করার জন্য একদল শাসক থাকবে, ততদিন তাদের হাতে সেই সমাজের আধুনিকতম প্রযুক্তির নির্যাতনের অস্ত্র থাকবে।”[১]

ব্যর্থ রাষ্ট্র-এর তকমা পাওয়া এসব কেন্দ্রীভূত সামরিক কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে কিছুটা পশ্চাৎপদ এসব ভঙ্গুর রাষ্ট্রগুলো তাদের কাজ সাম্রাজ্যবাদী-সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রগুলোর মতো সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারছে না; আর এজন্যই এদেরকে ভঙ্গুর বা ব্যর্থ রাষ্ট্র বলা হচ্ছে। তবে গণনিপীড়নে এবং গণশোষণে যাতে সফল হয়, সেজন্যই তো উত্তর-ঔপনিবেশিককালে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী ও একচেটিয়া দাতাগোষ্ঠী কর্তৃক অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে সেসব রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা যদি রাষ্ট্রের মূল চরিত্রকে ভুলে যাই, তবে বিভ্রান্ত বাড়ার সম্ভাবনা কমে না।

আরো পড়ুন:  চিলি দক্ষিণ আমেরিকার পুঁজিবাদ অভিমুখী শোষণমূলক নিপীড়িত দেশ

তথ্যসূত্র:

১. ভি আই লেনিন, রাষ্ট্র, ১১ জুলাই, ১৯১৯, শার্দলভ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া ভাষণ।

২.ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, প্রথম আলো, ২৩ নভেম্বর, ২০১২, বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র নয় কেন? লিংক: archive.prothom-alo.com/detail/date/2012-11-23/news/307941

৩. অনুপ সাদি, মার্কসবাদ, ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা ২০১৬, পৃষ্ঠা ৫৫-৬২

Leave a Comment

error: Content is protected !!