বুর্জোয়া বা বুর্জোয়াজি বলতে কি বুঝায়?

বুর্জোয়া বা বুর্জোয়াজি (ফরাসি: Bourgeosie) কথাটি একটি ফরাসি শব্দ। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নগরবাসী। পূর্বে নগরকে বলা হত ‘বুর’ (bourg)। বুর-এর অধিবাসীরা বুর্জোয়া বলে অভিহিত। পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভব হয় ওইসব নগরগুলিতে। শিল্পোন্নয়নে সেগুলি সমৃদ্ধি লাভ করে। যান্ত্রিক অগ্রগতির ফলে ইউরােপে উৎপাদন বাবস্থায় আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। মানুষের পরিবর্তে উৎপাদন যন্ত্রই ক্রমশ বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে। মানুষের চাহিদার পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থারও দ্রুত সম্প্রসারণ হয়। নানাবিধ পেশারও উদ্ভব ঘটে। নতুন উৎপাদন পদ্ধতি ও নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিকশিত হতে থাকে। এই নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত নগরবাসীরাই বুর্জোয়া নামে পরিচিত। নগরে জীবিকান্বেষণে আগত সাধারণ লােক যারা কারিগরি, দোকানদারি, কেরানিগিরি ও অন্যান্য নানান বুদ্ধিজীবীর কাজে জড়িত হয় তারা পেটি বুর্জোয়া বলে অভিহিত। তারা প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণিদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে।

এদিকে সামন্তদের অধীনে ক্রীতদাসবৎ, দায়বদ্ধ কৃষকেরা (serf) অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নগরের দিকে পলায়নপর হয়। কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবন তাদের সেদিকে আকর্ষণ করত। ফলে বুর্জোয়াদের সাঙ্গে সামন্তবাদীদের তুমুল বিরােধ দেখা দেয়। সামন্তদের দাপটে সারা সমাজই জর্জরিত—সকলেই চায় তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি। বুর্জোয়ারাই সামন্তবাদীদের উৎপীড়ন সবচেয়ে বেশি ভােগ করে। তারাই সেজন্য সামন্তবাদের উচ্ছেদকল্পে বিপ্লবের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। সংক্ষেপে এই বিপ্লবকেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলা হয়।

মার্কসীয় দৃষ্টিতে শ্রেণিগতভাবে বুর্জোয়া বা বুর্জোয়াজি-এর অন্তর্গত হলো পুঁজিবাদী, মিলমালিক, বণিক প্রভৃতি যারা ব্যবসাবাণিজ্যের মালিক (কৃষি ব্যতিরেকে)। এই বিভাজন অনুযায়ী বুর্জোয়াজি শ্রেণির একদিকে থাকে শিল্পপতি ও অর্থলগ্নিকারী, অন্যদিকে পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি যাদের জীবনযাত্রার মান সর্বহারা শ্রেণি থেকে খুব বেশি উন্নত নয়। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী শিল্পোন্নয়ন তথা আধুনিক কলকারখানার উন্নতির সঙ্গে বুর্জোয়াজি শাসক শ্রেণিতে পরিণত হয়, সামন্তবাদী শ্রেণি ও তার সাবেকি উৎপাদন ব্যবস্থা নিক্ষিপ্ত হয়। সমাজে সামন্তবাদেরর যােগসূত্র ছিন্ন করতে বুর্জোয়াজির উত্থানের সঙ্গে উদারতাবাদ প্রাধান্য পায়। মার্কসীয় চিন্তানুসারে বুর্জোয়াজি শ্রেণিসংগ্রামে সর্বহারা শ্রেণি দ্বারা পর্যুদস্ত হয়। মধ্যবর্তী পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি (কৃষিজীবী সহ) সর্বহারা শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত হয়। শ্রেণি হিসাবে বুর্জোয়াজি আরও ছােট আকারে পরিণত হয়ে দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে।

আরো পড়ুন:  কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২১৩।

1 thought on “বুর্জোয়া বা বুর্জোয়াজি বলতে কি বুঝায়?”

  1. সুন্দর উপস্থাপন। অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!