সাম্যবাদ বা কমিউনিজম (ইংরেজি: Communism) শব্দটি বিবিধার্থে ব্যবহৃত হয়। মাধ্যম এবং লক্ষ্যও বিভিন্ন জনের কাছে সব সময় সমান নয়। যে সমাজ ব্যবস্থায় সম্পত্তির মালিকানা হয় সর্বসাধারণের; প্রতি ব্যক্তি তার প্রয়ােজন অনুযায়ী সব কিছু পায় এবং তার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করে; এবং এই সাম্যবাদী ব্যবস্থা বৈপ্লবিক আন্দোলন এবং পুঁজিবাদের উচ্ছেদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন ব্যবস্থায় সর্বহারার একনায়কত্ব গড়ে ওঠে। সমগ্র এই ব্যবস্থার পিছনে ক্রিয়াশীল থাকে মার্কসবাদী মতাদর্শ।
মার্কস উল্লেখ করেছেন যে আঠারাে শতকের ত্রিশের দশকে প্যারিসে বিপ্লবীদের গুপ্ত সমিতিতে শব্দটির উদ্ভব হয়, যা দুটি ভিন্ন কিন্তু সম্পৃক্ত অর্থে ব্যবহৃত হতো, পুঁজিবাদী দেশে শ্রমিকদের বৈপ্লবিক আন্দোলন এবং তার মাধ্যমে বিশেষ এক সমাজব্যবস্থার পত্তন, যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না।
রবার্ট ওয়েনের অনুগামীরা ফরাসি communisme শব্দের অনুসরণে ইংল্যান্ডে ১৮৪০-এর দশকে শব্দটিকে ব্যবহারবহুল করেন। ফরাসি ভাষায় পুরানাে গ্রামভিত্তিক সমাজ le commune নামে অভিহিত হতো।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশ করেন। ইংরেজ ও ফরাসি স্বপ্নবিলাসীদের ব্যবহৃত সমাজতন্ত্র বা ‘সােসালিজম’ শব্দ থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পৃথক করার উদ্দেশ্যে তাঁরা কমিউনিস্ট শব্দটি ব্যবহার করেন। তা হলেও শ্রমিক আন্দোলনে সােসালিজম ও সাম্যবাদ বা কমিউনিজম শব্দ দুটি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও সমার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমটির ব্যবহারই বরং বেশি। এমনকী সােসাল ডেমােক্রেটিক শব্দেও আপত্তি ছিল না। কিন্তু শব্দ দুটির মধ্যে কালক্রমে যথার্থ অর্থগত পার্থক্য প্রাধান্য পায়।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তৃতীয় সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক (কমিন্টার্ন) প্রতিষ্ঠার সময়ে অন্যান্য সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের সঙ্গে পার্থক্য নিরূপণের উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট শব্দটি অগ্রাধিকার পায়। যেমন উনিশ শতকের মধ্যকালেও শব্দটি অন্যান্য সংস্কারবাদী সাংবিধানিক পরিবর্তনকামী সমাজতন্ত্রীদের থেকে ভিন্ন সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের মাধ্যমে পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রের উচ্ছেদের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল।
দ্বিতীয় যে অর্থে শব্দটি প্রযুক্ত হয় অর্থাৎ সমাজব্যবস্থা— সে সম্পর্কে মার্কসের অভিমত ছিল যে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না এবং শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কমিউনিস্ট সমাজকে মার্কস দুটি স্তরে বিন্যস্ত করেন। প্রথম স্তরে যখন সমাজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে সদ্য বেরিয়ে এসেছে তখন লােকে মজুরি পাবে ভােগ্য বস্তু কেনার জন্য (বিনিময় ব্যবস্থা অনুসারে) এবং উচ্চতর স্তরে লােকে সমাজকে তাদের সাধ্যানুসারে দেবে এবং সামাজিক সাধারণ ভাণ্ডার থেকে প্রয়ােজন অনুযায়ী নেবে ।
ভ্লাদিমির লেনিন তাঁর ‘স্টেট অ্যান্ড রেভল্যুশন’ গ্রন্থে স্তর দুটির সােসালিজম ও কমিউনিজম নামকরণ করেন। উচ্চতর কমিউনিস্ট স্তরে শ্রেণিহীন ব্যবস্থায় উৎপাদন ও বন্টনে সম্পত্তির মালিকানা হবে সর্বসাধারণের এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যথার্থ সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদিকা শক্তির পরিপুষ্টি তথা মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ঘটবে।
সমাজতন্ত্রী বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা মার্কসীয় মতানুসারে অবশ্যম্ভাবী। ফলে গড়ে ওঠে সর্বহারার একনায়কত্ব। পরিশেষে রাষ্ট্রের অবলুপ্তি (wither away) ঘটে। সােসালিস্ট বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন হল সর্বধরনের কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য।
দ্রষ্টব্য: সমাজতন্ত্র
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬৭-৬৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।