মতান্ধতাবাদ বা dogmatism হচ্ছে অধিবিদ্যাগতভাবে একপেশে, ছকে-বাঁধা ও শিলীভূত চিন্তা, যা কাজ করে অন্ধ মতগুলি নিয়ে। মতান্ধতার ভিত্তি হলো কোনো কর্তৃত্বক্ষমতায় অন্ধ বিশ্বাস এবং অচল-সেকেলে প্রতিজ্ঞাগুলি সমর্থন, সাধারণত ধর্মীয় চিন্তায় চিহ্নিত।[১] মতান্ধতাবাদের খ্রিস্টান ধর্ম অনুযায়ী অর্থ হলো দৈববলে লব্ধ জ্ঞান এবং যাজকবর্গই হলো তার ভাষ্যকার; যিনি এই ধর্ম গ্রহণ করেন তাঁর থাকা চাই অন্ধের মতো বিশ্বাস। রাজনীতির ক্ষেত্রেও অনেক তত্ত্ব থাকে যা যুক্তিতর্কের মধ্যে দিয়ে গৃহীত ও বর্জিত হয়। আবার বিনা বিচারে বহু কিছু অনেকে বিশ্বাস করে নেন। কারও দৃষ্টিতে সমাজতন্ত্র অকাট্য সত্য, কেউ মনে করেন অবাধ বাণিজ্যই চূড়ান্ত কল্যাণকর। মতান্ধতা প্রত্যয়টির মধ্যে শেষ কথা বলে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে মতবাদ হলো কাজ ও আদর্শের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানের প্রয়াস।[২]
শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে মতান্ধতার ফলে দেখা দেয় মার্কসবাদের বিকৃতিসাধন, দক্ষিণপন্থি ও বামপন্থি সুবিধাবাদ, সংকীর্ণতাবাদ ও রাজনৈতিক হঠকারিতা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মতান্ধতার মোকাবিলা করে তত্ত্বের সৃষ্টিশীল বিকাশ ও মূর্ত সত্যের দ্বান্দ্বিক নীতি নিয়ে।[৩] মতান্ধতাবাদকে বাংলা ভাষায় গোঁড়ামিবাদও বলা হয়।
মতান্ধতায় কারও কোনও বিশ্বাসের উদ্ভব ও প্রকৃতি যাই হোক না কেন সেই বিশ্বাসকে যুক্তিহীনভাবে আঁকড়ে ধরা হয়ে থাকে। সেই বিশ্বাস বা ধারণার বিপরীত যুক্তি বা প্রমাণ গ্রহণ না করে নিজের মতে মতান্ধ মানুষ অবিচল থাকে। মতান্ধ ব্যক্তিও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বিজ্ঞান ও নানা যুক্তির সাহায্য নেয়।[৪] মতান্ধতাবাদিরা অনুশীলনকে ছোটো করে দেখে এবং যে কোনো মতবাদ বা আদর্শকে আপ্তবাক্য হিসেবে দেখাতে চায়। ফলে তারা একপেশে অচল, স্থির চিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তারা শুরু করে তত্ত্বকথা দিয়ে এবং শেষও করে তত্ত্বকথা দিয়ে। কিন্তু একজন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদির কাছে অনুশীলন হচ্ছে প্রাথমিক স্থানে এবং তত্ত্ব পরের স্থানে। অর্থাৎ অনুশীলন থেকেই আসে তত্ত্ব বা জ্ঞান এবং সমস্ত জ্ঞানই অনুশীলনের জন্য।
অনাপেক্ষিক ও আপেক্ষিক সত্যের দ্বান্দ্বিকতা সম্বন্ধে ভুল ধারনা থেকে মতান্ধতাবাদের উদ্ভব। মতান্ধতাবাদ অবধারণা বা Cognition-এর অনাপেক্ষিক উপাদানটিকে অতিরঞ্জিত করে এবং তার আপেক্ষিক চরিত্রকে অস্বীকার করে। অর্থাৎ মতান্ধতার বৈশিষ্ট্য হল সত্য সম্বন্ধে একটা একপক্ষীয় মনোভাব। জীবন ও কর্মপ্রয়োগের সংগে সংস্পর্শহীন হওয়ায় মতান্ধতাবাদিরা কাজ করে স্থির, নিশ্চল, ধ্রুব ধারণা আর সূত্র নিয়ে, সেগুলোকে প্রয়োগ করে এমন সব ব্যাপার ও ঘটনার ক্ষেত্রে যেখানে সেগুলো প্রয়োগ করা চলে না। মতান্ধতাবাদ প্রকাশ পায় যান্ত্রিকভাবে মুখস্ত করা প্রতিজ্ঞা, একগুঁয়ে মনোভাব ও আমলাতান্ত্রিক কর্মপ্রক্রিয়ার বারংবার পুনরাবৃত্তির মধ্যে। অর্থাৎ জ্ঞান বা তত্ত্বের কোনো কোনো প্রতিজ্ঞা, সিদ্ধান্ত বা সূত্রকে সেই প্রতিজ্ঞা, সিদ্ধান্ত বা সূত্রের মূর্ত-নির্দিষ্ট অবস্থা, স্থান ও কালের প্রেক্ষিতের বাইরে বিবেচনা করা থেকে মতান্ধতাবাদ জন্ম নেয়। মতান্ধতাবাদিরা বিজ্ঞান ও কর্মপ্রয়োগের প্রয়োজন-নির্বিশেষে অপরিবর্তনীয় ধারনাকে সূত্রাকারে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।
মতান্ধতাবাদিরা একটি দেশের একটি নির্দিষ্ট সময়ের সেই অবস্থার জন্য কোনো মত বা তত্ত্বকে উপযোগি কি অনুপযোগি তা বিবেচনা না করেই সেই পুরোনো মতের পক্ষে কাজে নেমে পড়ে। অর্থাৎ মতান্ধতাবাদিদের চিন্তা পরিবর্তনশীল বাস্তব পরিস্থিতির সংগে এগিয়ে যেতে পারে না এবং তাদের চিন্তাধারা সামাজিক অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন। অনুশীলন ও জ্ঞানের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, করা ও জানার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, বাস্তব অবস্থা ও আত্মগত বিচ্ছিন্নতা থেকে আসে ভাববাদ ও যান্ত্রিক বস্তুবাদ এবং সুবিধাবাদ ও হঠকারিতা।[৫] মাও সেতুং আরো বলেছেন,
মতান্ধতাবাদ ও সংশোধনবাদ উভয়ই মার্কসবাদের পরিপন্থী। মার্কসবাদ অবশ্যই এগিয়ে যাবে, অনুশীলনের বিকাশের সংগে সংগে অবশ্যই বিকাশ লাভ করবে, এটা অচল থাকতে পারে না। নিশ্চল ও অপরিবর্তিত থাকলে এটা হয়ে পড়বে প্রাণহীন। কিন্তু মার্কসবাদের মৌলিক নীতিকে অবশ্যই লঙ্ঘন করা চলবে না, অন্যথায়, ভুল করা হবে। আধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ দিয়ে মার্কসবাদকে দেখা এবং এটাকে অনড়-অটল কিছু একটা বলে ভাবাই হচ্ছে মতান্ধতাবাদ।[৬]
মার্কসবাদীরা মতান্ধতার নিন্দা করেন, কারণ তাতে মার্কসীয় সৃজনশীলতা ক্ষুন্ন হয়। কিন্তু সুবিধাবাদ, সংশোধনবাদ প্রভৃতি অভিযোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মতান্ধতাই শেষাবধি আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু তাতে সৃজনশীল কর্মপ্রক্রিয়া থাকে না। মতান্ধতাবাদকে প্রতিরোধ করতে হবে ভাববাদ ও যান্ত্রিক বস্তুবাদ এবং সুবিধাবাদ ও হঠকারিতার কানাগলি থেকে বিপ্লবকে এগিয়ে নেয়া এবং বিপ্লবী তত্ত্বের সৃজনশীল বিকাশের জন্য।
তথ্যসূত্রঃ
১. ক্রাপিভিন, ভাসিলি; দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কী; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৮৯; পৃষ্ঠা ৩৫২।
২ গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩৩২-৩৩৩।
৩ ক্রাপিভিন, পূর্বোক্ত।
৪ গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত।
৫. মাও সেতুং, দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে, নির্বাচিত রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, চলন্তিকা বইঘর, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৩০২।
৬. মাও সেতুং, প্রচারকার্য সম্পর্কে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ, ১২ মার্চ, ১৯৫৭
রচনাকাল: ২৪ জানুয়ারি, ২০১৩
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।