সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে এক দেশ বা জাতি কর্তৃক অপর দেশ বা জাতির উপর প্রভুত্ব

সাধারণ দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদ (ইংরেজি: Imperialism) হচ্ছে একটি দেশ বা জাতি কর্তৃক অপর একটি দেশ বা জাতির উপর প্রভুত্ব ও শাসন কায়েম করা।[১] আধুনিক ইতিহাসে ইংরেজ, ফরাসি, স্পেনীয় ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাম বিশেষভাবে পরিচিত। অপরের উপর নিজের শাসন ও সভ্যতা বিস্তারের মারফত প্রভুত্ব কায়েম করা, অসম আচরণ ও অত্যাচার ও শোষণের মাধ্যমে অধীনস্থ জাতির উপর নিয়ন্ত্রণ স্থায়ী রাখার ব্যবস্থা, ইচ্ছা ও কৌশলে প্রাচীন ও আধুনিক সাম্রাজ্যসমূহের মধ্যে অনেক মিল দেখা যায়।[২]

ব্যাপক অর্থে ইতিহাসের প্রাচীন কালেও সাম্রাজ্য এবং সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব দেখা দেয়। প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে সুমেরিয়, মিশরীয়, আসেরিয়, পারস্য, রোম এবং চীন সাম্রাজ্যের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মধ্যযুগে রোমান, বাইজানটাইন, অটোমান, মোগল সাম্রাজ্য ছিল। অতীতে সাম্রাজ্য বিস্তারের একটি প্রধান প্রেরণা ছিল কোনো বিশেষ সম্রাট বা জাতির নিজের ক্ষমতার পরিচয় দানের ইচ্ছা। অপর জাতির শোষন ও দমনের মধ্যে প্রভু জাতি ও তার সম্রাট আপন শৌর্য-বীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখতে পেত।[২]

বর্তমানকালে ইউরোপে শিল্পোন্নয়নের পর আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। সেগুলির বাণিজ্যিক প্রয়োজনে সারা পৃথিবীতে পঞ্চদশ শতক থেকে নতুন দেশ আবিষ্কার ও উপনিবেশ স্থাপনসূত্রে সাম্রাজ্যবাদ নতুন আকারে গড়ে ওঠে। বলপ্রয়োগ করে ইউরোপীয় কিছু দেশ দুর্বল অন্যান্য দেশে আধিপত্য ও শাসন বিস্তার করে। স্পেন ও পর্তুগাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স ব্যবসা বাণিজ্যের তাগিদে পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সৃষ্টি করে। উনিশ শতকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিমণ্ডলীতে হল্যান্ড ও বেলজিয়াম যুক্ত হয়। ওই শতকে জাতীয় শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে বিলম্বের দরুন জার্মানি, জাপান ও ইতালি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। তাই বিশ শতকে সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রয়োজনে সামরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। উল্লেখ্য, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ অনেকাংশে সমার্থক হলেও প্রত্যয় দুটির মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। অধীনস্থ উপনিবেশগুলিতে রাজনৈতিক ও আইনগত অধিকার কম দেওয়া হয়। দাসপ্রথা সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গ হলেও, প্রাচীনকালে বিজিত ভূখণ্ড মূল সাম্রাজ্যবাদী দেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে যেত। ফলে সেগুলি আর উপনিবেশ হিসেবে বিবেচিত হত না।

আরো পড়ুন:  কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন একটি স্বাধীনতাবিরোধী আন্দোলন

সাম্রাজ্যবাদ শব্দটির সংজ্ঞা নিরূপণ সহজ নয়। নিন্দার্থে শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার চলে। সামরিক অভিযান ও ভিন্ন দেশ দখল না করেও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ গড়ে উঠেছে। তাহলেও সর্বগ্রাহ্য প্রচলিত অর্থে একটি দেশ অপর একটি দেশের উপর আত্মগরিমা জাহির ও অর্থনৈতিক শোষণের জন্য সশস্ত্র শক্তি নিয়ে নিজের সার্বভৌমত্ব আরোপ করে। উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পাবার ফলে ইংল্যান্ডে সাম্রাজ্যবাদের স্বেচ্ছাচার ও উৎপীড়নের চেহারা ক্রমে বিভিন্ন রাজনীতিক ও সাংবাদিকের চোখে প্রকট হয়ে পড়ে। ১৯০২ সালে ইংল্যান্ডের একজন অর্থনীতিবিদ জন অ্যাটকিনসন হবসন (১৮৫৮-১৯৪০) তাঁর ‘ইম্পিরিয়ালিজম’ নামক গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে আনুপূর্বিক আলোচনা করেন। আফ্রিকায় বুয়র যুদ্ধ থেকে হবসনের সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের সাহায্যে হবসন দেখিয়েছেন যে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ এশিয়া ও আফ্রিকাতে সামরিক শক্তির সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদী যেসব লুঠতরাজ চালিয়েছে তার পিছনে ছিল তাদের নিজেদের ধনী শিল্পপতিদের উৎপন্ন শিল্পসামগ্রী বেচার উপযোগী নতুন বাজার খুঁজে বের করা এবং সেই সঙ্গে শস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহের অভিসন্ধি। হবসন প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি সচেতনভাবেই যে পন্থা অনুসরণ করত সেটা একচেটিয়া পুঁজিবাদেরই লক্ষণ।[১]

হবসনের চিন্তার সূত্র ধরেই লেনিন ১৯১৬ সালে লিখিত তাঁর সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় (১৯১৬) গ্রন্থে বলেন যে একচেটিয়া পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ পর্যায় হিসেবে বিগত শতকের শেষে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটেছে যখন একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও আর্থিক মূলধন তাকে রাজনৈতিক দিক থেকে সর্বশক্তিমান করে তুলেছে এবং পৃথিবীকে প্রধান কয়েকটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে। পুঁজিবাদের অসমান উন্নয়নের ফলে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে উৎপন্ন সামগ্রী ও উদ্বৃত্ত মূলধন রপ্তানি ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য বাজার তথা অনুন্নত দেশগুলিকে পদানত করা এবং নিজেদের বিশ্বের সেরা শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে। তার পরিণাম স্থানীয় বিনাশ ও বিশ্বযুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় গ্রন্থে লেনিন পুঁজিবাদের একটা বিশেষ পর্যায়রূপে সাম্রাজ্যবাদকে চিহ্নিত করেন। লেনিনের মতে,

“সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের বিকাশের সেই পর্যায়, যেখানে একচেটিয়া কারবার ও ফিনান্স পুঁজির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত, পুঁজির রপ্তানি যেখানে একটা অতি বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছে, শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাস্টগুলোর মধ্যে বিশ্বের বাটোয়ারা এবং বৃহত্তম পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে ভূগোলকের সমস্ত অঞ্চলের বাটোয়ারা সমাপ্ত হয়েছে।”[৩]

উক্ত গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক মর্মার্থ, তার বিরোধসমূহ এবং ধংসের অনিবার্যতা উদঘাটিত করে দেখান এবং এই সিদ্ধান্তে আসেন যে সাম্রাজ্যবাদ হলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাককাল। এই রচনাটি মাকসের ‘পুঁজি’ গ্রন্থের মূল বক্তব্যগুলির প্রত্যক্ষ অনুবর্তন ও সৃজনী বিকাশ। বিপুল বাস্তব তথ্য আর তাত্ত্বিক মালমসলার সার্বিকীকরণ করে লেনিন অতি গুরুত্বপূর্ণ এই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে আসেন যে সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদের বিকাশ অসমান এবং উল্লম্ফনধর্মী, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিজয় লাভ করতে পারে প্রথমে অল্প কয়েকটি, এমনকি পৃথক একটি পুঁজিবাদী দেশেও। বিশ্ব বৈপ্লবিক আন্দোলনের কাছে এ সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অসাধারণ বিপুল। এই বই লেখার পরেও সাম্রাজ্যবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তিনি চালিয়ে যান আরো অনেক রচনায়। লেনিন বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখান যে, দেশে দেশে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেই সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটবে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কালে লেনিন ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধের ঘোর বিরোধী এবং তাতে সঙ্গতিনিষ্ঠ। গুরত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্তে তিনি আসেন যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অবসান সম্ভব কেবল আন্তর্জাতিক প্রলেতারীয় ঐক্য শক্তিশালী করে জনসাধারণের বৈপ্লবিক প্রতিরোধের বিকাশ মারফত।[৪] 

আরো পড়ুন:  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসবাদী যুদ্ধবাজ গণহত্যাকারী পরপীড়ক প্রজাতন্ত্র

সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ছাড়াও অন্যান্য কারণও থাকতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। জাতীয়তাবাদী আগ্রাসী নীতি, নেতাদের রাজনৈতিক আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা এবং বিশেষ কোনো মতাদর্শ প্রচার অথবা রক্ষার তাগিদেও অপর দেশ দখলের নজির দেখা গেছে।

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩৩২-৩৩৩।

২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২১৩।

৩. লেনিন, ভি আই. সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়, অধ্যায় ৭, “পুঁজিবাদের বিশেষ একটি পর্যায় স্বরূপ সাম্রাজ্যবাদ”, ১৯১৬, নির্বাচিত রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড (বার খণ্ডে) প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১১৫।

৪. ভ. বুজুয়েভ ও ভ. গরোদনভ, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!