উপনিবেশবাদ বা ঔপনিবেশিকতাবাদ (ইংরেজি: Colonialism) শব্দটি দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধোত্তরকালে বিশেষ করে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সাম্রাজ্যবাদ শব্দটির সমার্থে ব্যবহারবহুল হয়েছে। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো যে সব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মপন্থার সাহায্যে একটি সাম্রাজ্যশক্তি অন্যান্য দেশ কিংবা অধিবাসীদের উপর নিয়ন্ত্রণ, সম্প্রসারণ অথবা বিস্তার বজায় রাখে। শব্দটির অর্থ সাম্রাজ্যবাদের সমতুল্য। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধের আগে শব্দটির দ্বারা সাম্রাজ্য বিস্তার ও শিল্পোন্নয়নের জন্য আইনকানুন বিধিবদ্ধকরণে যে ঔপনিবেশিক রীতিনীতি বা কর্মপন্থা অনুসৃত হতো সেকথা বোঝাত।
আগেকার কালে শব্দটির দ্বারা বোঝাত যে এক এক স্থানের কিছু অধিবাসী যখন নিজ দেশ ছেড়ে সাগরপারে সুদূর কোনো দেশে গিয়ে যে বসতি বা উপনিবেশ স্থাপন করত। ইউরোপের অধিবাসীরা দলে দলে আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে এবং তারও আগে গ্রিসের অধিবাসীরা সিসিলি, দক্ষিণ ইতালি প্রভৃতি স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করে বসবাস করত।[১] উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং উপনিবেশগুলোর মধ্যে ফারাককে যত্ন করে টিকিয়ে রাখা হয়। আইনের চোখেই হোক বা শাসনের প্রাত্যহিক নিয়মের মধ্যে দিয়েই হোক, উপনিবেশবাদের মূল কথাই হল এই অসাম্য: কেন্দ্রের অধিবাসী, ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের জন্য এক আইন আর উপনিবেশের মানুষদের জন্য অন্য আইন। কেন্দ্রের সুযোগ সুবিধের পাল্লা উপনিবেশের তুলনায় সব সময়ই ভারি।[২]
অবশ্য ইদানীং শব্দটির বহুল প্রচলন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের সূত্রে বিস্তার লাভ করেছে। সপ্তদশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাবধি ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যাণ্ড, ইতালি, জাপান প্রভৃতি পুঁজিবাদী দেশ বিশ্বের বিভিন্ন অনুন্নত দেশ জবরদস্তি করে দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করে। উদ্দেশ্য ছিলো নিজ দেশের উদ্বৃত্ত মূলধন উপনিবেশে লগ্নি করা, উপনিবেশে শ্রমিকের সস্তা মজুরি এবং সেখানকার কাঁচামাল সস্তায় শিল্প বাণিজ্যে নিয়োগ করা। উপনিবেশগুলিতে অর্থনৈতিক শোষণের দ্বারা স্বদেশের প্রভূত উন্নতিবিধান করা হয়। প্রথম সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধে কিছুটা এবং দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধে বহুলাংশে ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষয়-ক্ষতি এবং দায়দেনার ফলে ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ আর্থিক দিকে সবিশেষ পর্যুদস্ত হয়। সে কারণে উপনিবেশগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে রাখা নিরর্থক হয়ে দাঁড়ানোয় সেগুলি সাম্রাজ্যবাদীরা ছেড়ে চলে যায়।[৩]
পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ছিল উপনিবেশবাদের স্বর্ণযুগ। এই সময়ে ইউরোপের কিছু দেশ পৃথিবীর অধিকাংশ ভূখণ্ড দখল করে সেখানকার মানুষদের ঔপনিবেশিক শাসনের নিয়ন্ত্রণে আনে। বলা যায় গোটা দুনিয়াটা ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন ইত্যাদি কয়েকটি দেশের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপের দেশগুলো যখন এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে তখন তারা সেখানকার মানুষ ও সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয়। এই সমাজগুলো, তাদের সংস্কৃতি, মানুষদের চেহারা, পোষাক, আচার ব্যবহার ছিলো পুরোপুরি আলাদা। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা নিজেদের শাসনকে একটা নৈতিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য এই পার্থক্যগুলোকে ব্যবহার করে। ঔপনিবেশিকদের লেখা বইয়ের পর বই, নৃতত্ত্ববিদ্যা জাতীয় তথাকথিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের চর্চায়, ইতিহাসে, ধর্মযাজকদের বক্তৃতায় বারবার প্রমাণ করা হতে থাকে ইউরোপের সভ্য সমাজগুলোর তুলনায় এই সমাজগুলো কত পিছিয়ে পড়া, কত বর্বর। কেন ইউরোপের দ্বারা শাসিত হওয়াটাই এদের সুসভ্য হওয়ার একমাত্র পথ। আর এই ভাবে সভ্যতার নামে পৃথিবীর এই বিশাল ভূখণ্ড থেকে লুঠ করে নেওয়া হলো সব রকমের সম্পদ। উপনিবেশবাদ শুরু হওয়ার আগে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশের সম্পদ ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ছিলো। কিন্তু উপনিবেশবাদী লুণ্ঠনের ফলে এই ৫০০ বছরে পৃথিবীর ভারসাম্য অনেকটাই পশ্চিমের পক্ষে ঝুঁকে পড়ে। ইংল্যান্ডের মতো ছোট একটা দেশ ঔপনিবেশিক শোষণের মধ্যে দিয়ে প্রায় রাতারাতি পৃথিবীর ধনীতম দেশগুলোর মধ্যে একটা হয়ে উঠেছিল।[৪]
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতে রেলপথ এবং সেচ নির্মাণের বিষয়ে কার্ল মার্কস অনেক কিছু লিখেছেন, তবে মার্কস সেসব লেখায় উল্লেখ করেছেন যে, ভারতে রেলপথ নির্মাণ ও অন্যান্য উন্নয়ন ছিলো বিশাল ক্ষতি করার পরে সামান্য উন্নয়ন যা গরু মেরে জুতা দানের সমতুল্য। কার্ল মার্কস ভারতে ব্রিটিশ লুণ্ঠন প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“এশিয়ায় অবিস্মরণীয় কাল থেকে সরকারের সাধারণত শুধু তিনটি বিভাগ বর্তমান ছিল, কোষাগার বা রাজস্ব অর্থাৎ অভ্যন্তর লুণ্ঠনের বিভাগ, যুদ্ধ অর্থাৎ বহির্দেশ লুণ্ঠনের বিভাগ, এবং পরিশেষে পাবলিক ওয়ার্কসের বিভাগ। … …
পূর্ব ভারতে বৃটিশ তাদের পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে রাজস্ব ও যুদ্ধের বিভাগটি গ্রহণ করেছিল বটে, কিন্তু পাবলিক ওয়ার্কসটা একেবারেই অবহেলা করেছে। সেই জন্যেই কৃষির এ ধ্বংস।[৫]
ভারতের প্রগতিতে এতদিন পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেনের শাসক শ্রেণীগুলির যা স্বার্থ ছিলো সেটা নিতান্ত আকস্মিক, অস্থায়ী ও ব্যতিরেকমূলক। অভিজাত শ্রেণি চেয়েছিলো জয় করতে, ধনপতিরা চেয়েছিল লুণ্ঠন, এবং মিলতন্ত্রীরা চেয়েছিল সস্তায় বেচে বাজার দখল।”[৬]
আমরা উপনিবেশিকতার বর্ণনায় নিয়মিতভাবে উদ্ভূত তিনটি বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করতে পারি: আধিপত্য, সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং শোষণ।[৭] যখন কোনো এলাকার গোষ্ঠী ব্যক্তি বা জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তখন অস্ত্র, যুদ্ধ ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় আধিপত্য কায়েম করা হয়। সাংস্কৃতিক আধিপত্যের জন্য বর্ণ, ভাষা, ধর্ম ইত্যাদির শ্রেষ্ঠত্বের বকুনি ছাড়া হয়। শোষণ করার জন্য পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার জোরপূর্বক প্রচলন, বাণিজ্যের জোরপূর্বক বিস্তার, উপনিবেশিত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুট, কাঁচামালের লুট, নিপীড়িত দেশের কারখানার ধ্বংস, উপনিবেশিত দেশের সাথে আধিপত্যকারী দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে শোষণমূলক ব্যবস্থা, দাস ব্যবসা, ভূমিদাসকে কৃষি থেকে উৎখাত ইত্যাদি কাজে লাগানো হয়।
মার্কস পুঁজির সভ্যতা বিস্তারী দিকটির কথা বলেন, কিন্তু উপনিবেশকরণকে নৈতিকভাবে সমর্থন করেননি। পুঁজির সভ্যতা বিস্তারের প্রক্রিয়ার সাথে যে অমানবিক দিক জড়িত থাকে তাকেও মার্কস বিবেচনা করেন।[৮] ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বর্বর দিক সম্পর্কে মার্কস বলেন,
“রক্ত আর কাদা, দুর্দশা ও দীনতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিবর্গ ও জাতিকে টেনে না নিয়ে বুর্জোয়ারা কি কখনো কোনো অগ্রগতি ঘটিয়েছে?… স্বদেশে যা ভদ্র রূপ নেয় এবং উপনিবেশে গেলেই যা নগ্ন হয়ে আত্মপ্রকাশ করে সেই বুর্জোয়া সভ্যতার প্রগাঢ় কপটতা এবং অঙ্গাঙ্গি বর্বরতা আমাদের সামনে অনাবৃত।”[৯]
মার্কস পুঁজিকে দুদিক থেকে সমালোচনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, পুঁজির সভ্যতা বিস্তারী দিকটির সাথে এর বর্বর অমানবিক দিকও জড়িত যা নৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট সমালোচনার যোগ্য। ফলে নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হলেও পুঁজি বাস্তব বৈষয়িক জগতে যে পরিবর্তন সাধন করে সে দিকটাও দেখেন মার্কস। মার্কস কেবলমাত্র কতগুলি নৈতিক মূল্যবোধ থেকে বাস্তব ইতিহাসকে মূল্যায়ন করেন নি, তার মধ্যে যুগপৎ নৈর্বক্তিক-ঐতিহাসিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ বিরাজমান ছিল। তিনি উল্লেখ করেন বুর্জোয়া যুগকে ‘এক মহান সামাজিক বিপ্লব’[১০] বা সাম্যবাদী বিপ্লব কজ্জা করবে।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬৩।
২. চক্রবর্তী, রংগন. বুদ্ধিজীবীর নোটবই. চক্রবর্তী সুধীর সম্পাদিত, প্রথম নবযুগ সংস্করণ, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ পৃষ্ঠা ১৫৯-১৬১।
৩. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. পূর্বোক্ত।
৪. চক্রবর্তী, রংগন. পূর্বোক্ত।
৫. কার্ল মার্কস, ভারতে ব্রিটিশ শাসন, ১০ জুন ১৮৫৩, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, বারো খণ্ডে, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৩৮-৯।
৬. কার্ল মার্কস, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল, ২২ জুলাই ১৮৫৩, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, বারো খণ্ডে, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৪৬।
৭. Butt, Daniel. The International Encyclopedia of Ethics. Edited by Hugh LaFollette, 1st ed., Wiley-Blackwell, 2013.p. 892-898
৮. খান, আখতার সোবহান. মার্কসবাদ ও ন্যায়পরতার ধারণা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৮; পৃষ্ঠা ১২৬।
৯. কার্ল মার্কস, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫০।
১০. কার্ল মার্কস, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।