চেতনায় প্রতিফলিত বটে, কিন্তু চেতনা নিরপেক্ষ বাস্তব অস্তিত্বকে বস্তু (ইংরেজি: Matter) বলা হয়। বস্তুর অসংখ্য প্রকাশ, সর্বপ্রকার প্রকাশ, বিভিন্ন প্রকাশের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক, গতি সব কিছুর ধারক হচ্ছে বস্তু। গতি আর বস্তু ভিন্ন সত্তা নয়। গতিময়তা হচ্ছে বস্তুর অচ্ছেদ্য চরিত্র। কাজেই বিশেষ প্রকাশের বাইরে গতিহীন অনড় কোনো নির্বিশেষ বস্তুকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে না। বিভিন্ন প্রকাশকে তাদের গতি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে জানাই বস্তুকে জানা।
বস্তু নিয়ত বিবর্তিত হচ্ছে। বস্তুর বিবর্তনে যেমন চেতনার উদ্ভব ঘটছে, তেমনি চেতনার শক্তি বস্তুর বিবর্তনে এবং বস্তুর বৈচিত্রের বৃদ্ধিতে এক মাধ্যমের ভূমিকা পালন করে। বস্তুর বিকাশের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তুলনামুলকভাবে সহজ থেকে জটিলতা প্রাপ্তি। বস্তুর বিকাশ যত জটিল, তত বিচিত্র তার প্রকাশ এবং তাদের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ সম্পর্ক।
বস্তুর বিকাশের চরম পর্যায়ে চেতনাসম্পন্ন মানুষের উদ্ভব ঘটেছে। চেতনা বস্তুর বিকাশের ফল হলেও চেতনা ও বস্তুর চরিত্র এত পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয় যে, এই বিরোধিতার ভিত্তিতে ভাববাদী দার্শনিকগণ চেতনাকে বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং বস্তুর চেয়েও আদি ও মূলসত্তা বলে দাবি করেন। ভাববাদী দার্শনিকদের অনেকের মতে চেতনা যে কেবল অ-বস্তু তাই নয়। চেতনাই বস্তুর মূল। বস্তু চেতনারই প্রকাশ কিংবা বস্তু চেতনার কল্পনা মাত্র।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মতে বস্তু এবং চেতনার মধ্যকার বিরোধিতা আপেক্ষিক। বস্তু এবং চেতনার মধ্যে চরম কোনো বিরোধিতা থাকতে পারে না। বস্তুর সঙ্গে চেতনাসম্পন্ন মানুষের যে সম্পর্ক তাতে মানুষ তার পরিবেশকে নিয়ত পরিবর্তিত করে বস্তুর নতুনতর প্রকাশের এবং তাদের নতুনতর সাংগঠনিক সম্বন্ধের উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম এবং তা ঘটাচ্ছে। উৎপাদনের নতুনতর উপায়, দালানকোঠা, ঘর-বাড়ি তৈরি, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার বিধানসমূহের প্রয়োগে নতুনতর দ্রব্যসামগ্রীর সৃষ্টি-এসবই প্রকৃতি এবং পরিবেশের উপর মানুষের চেতনার হস্তক্ষেপের পরিফল।
বিজ্ঞান ও কারিগরী কৌশলকে মানুষ যত আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছে, বস্তুর প্রকাশের সংখ্যা এবং বৈচিত্র্য তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই মানুষ কেবল বস্তুর বিবর্তনের ফল নয়; মানুষ বস্তুর বিবর্তনের অন্যতম মাধ্যমও বটে। অর্থাৎ বস্তুর ক্ষেত্রে মানুষ কেবল সৃষ্টি নয়, মানুষ স্রষ্টাও। এই অভিমত ব্যক্ত করে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অন্যতম ব্যাখ্যাতা লেনিন বলেছিলেন, ‘মানুষের চেতনায় কেবল বাস্তব জগতের প্রতিফলন ঘটে না। মানুষের চেতনা বাস্তব জগতকে সৃষ্টিও করে।’
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৮১-২৮২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।