একে-৪৭ বা আভতোমাত কালাশনিকোভা বা একে ফোরটি সেভেন বা AK-47 হচ্ছে সাম্প্রতিক বিশ্বের জনপ্রিয়তম গ্যাস পরিচালিত স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। এই অস্ত্রের পরিকল্পনাকারী ছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মিখাইল কালাশনিকভ। সর্বমোট এই অস্ত্র এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটিরও বেশি বিক্রি হয়েছে এবং সারা দুনিয়ার প্রায় পঞ্চাশেরও বেশি দেশের সামরিক বাহিনীতে এই অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে এই হয়ে দাঁড়িয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় রাইফেল। ১৯৫১ সাল থেকে ইদানিংকাল পর্যন্ত এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ২০০৪ সালের একটি হিসাব অনুসারে, “আনুমানিক বিশ্বব্যাপী ছড়ানো ৫০ কোটি আগ্নেয়াস্ত্রের ভেতর, প্রায় ১০ কোটি হচ্ছে কালাশনিকভ পরিবারের অন্তর্গত, যার তিন-চতুর্থাংশ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের একে-৪৭ রাইফেল।”
এই একে ৪৭ রাইফেলের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এটির সহজ ব্যবহার, নির্ভরতা ও রক্ষানাবেক্ষন ইত্যাদি। এটাকে বিশ্বের প্রথম কার্যকর অটোমেটিক রাইফেল বলা হয়। সৈন্যদের মধ্যে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তার মূল কারণ এটি জলে ভিজিয়ে, ধুলাতে রেখে বা এর উপর দিয়ে রাস্তা মেরামতের রোলার চালানোর পরও এটিকে আগের মতই ব্যবহার করা যায়, যা এর সমপর্যায়ের অন্যান্য অস্ত্রের ক্ষেত্রে অসম্ভব।
সাত দশক পরেও, একে-৪৭ রাইফেলের মডেল এবং রূপগুলি ভয়ংকর অবস্থার অধীনেও অধিক নির্ভরযোগ্য, সমসাময়িক পশ্চিমা অস্ত্রগুলির তুলনায় এটির উৎপাদন ব্যয় কম, কার্যত প্রতিটি ভৌগলিক অঞ্চলে সহজলভ্যতা এবং ব্যবহারের সহজতার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত অ্যাসল্ট রাইফেল রয়ে গেছে। একে -৪৭ রাইফেল অনেক দেশে তৈরি করা হয়েছে এবং তারা সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে অনিয়মিত বাহিনী এবং সমুত্থানকারীদেরকে এটি সেবা দিয়ে চলেছে, এবং এই রাইফেল অন্যান্য অনেক ধরণের ব্যক্তি, ক্রু-পরিবেশিত এবং বিশেষায়িত আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির ভিত্তি ছিল। ২০০৪ সাল পর্যন্ত, “বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৫০ কোটি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি কালাশনিকভ পরিবারের অন্তর্গত, যার তিন-চতুর্থাংশ একে-৪৭ ফাইফেলসমূহ”।
সাংস্কৃতিক প্রভাব ও ফলাফল
স্নায়ু যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলি সারা বিশ্বের অসংখ্য দেশ এবং বিদ্রোহী বাহিনীকে অস্ত্র ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান সরবরাহ করেছিল। এই সময়ে পশ্চিমা আগ্রাসি দেশগুলি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল স্বয়ংক্রিয় রাইফেলগুলি ব্যবহার করেছিল যেমন এফএন এফএএল, এইচকে জি৩, এম১৪, এবং এম১৬। বিপরীতে, রাশিয়ানরা ও চীনারা ব্যবহার করে একে-৪৭; কারণ এর কম উৎপাদন খরচ এবং উৎপাদন সহজতর হবার কারণে তারা বিশাল সংখ্যক একে-৪৭ উৎপাদনের অনুমতি দেয়।
কমিউনিস্ট-প্রশ্রয়ী দেশগুলোর মধ্যে, AK-47 তৃতীয় বিশ্ব বিপ্লবের প্রতীক হয়ে ওঠে। এগুলো কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং কম্বোডিয়ান-ভিয়েতনামি যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির দ্বারা নিষিদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যথা ইরান, লিবিয়া এবং সিরিয়ার প্রধান অস্ত্র ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। সে সময় ইজরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইরত মধ্যপ্রাচের দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনকে স্বাগত জানিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, একে-৪৭ বন্দুকগুলো নগদ টাকায় খোলাখুলিভাবে এবং কালো বাজার উভয়ভাবে স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্র, মাদক কার্টেলসমূহে বা যে কোনো দলের কাছে বিক্রি হতে দেখা যায়। এবং সম্প্রতি সেগুলো ইসলামী গোষ্ঠীগুলির হাতে যেমন আল-কায়দা, আইএসআইএল, আফগানিস্তান ও ইরাকের তালিবান এবং ফার্ক এবং কলম্বিয়ার জাতীয় মুক্তি সেনার কাছে দেখা গেছে।
রাশিয়াতে, কালাশনিকভ জাতীয় গর্বের এক অসাধারণ উৎস।[১] “বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত হামলাকারী রাইফেলের উদ্ভাবকের পরিবার, মিখাইল কালাশনিকভ, জার্মান প্রকৌশল সংস্থা এমএমআইকে পরিচিত কালাশনিকভ নামটি তত-ভয়ংকর-নয় এমন পণ্যে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে”। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, কালাশনিকভ ভোডকা একে-৪৭ কালাশনিকভের আকারে স্যুভেনির বোতল দিয়ে বাজারজাতকরণ করা হয়েছে। কালাশনিকভ ঘড়ি, ছাতা এবং ছুরিও বাজারে আছে।
একে ৪৭ নিয়ে পূরবী মুখোপাধ্যায়ের একটি গান শুনুন ইউটিঊব থেকে
কালাশনিকভ যাদুঘর (এছাড়াও এটিকে একে-৪৭ জাদুঘরও বলা হয়) ৪ নভেম্বর ২০০৪ উদহুর্ত, উদমুর্ত প্রজাতন্ত্রে খোলা হয়েছে। এই শহর রাশিয়ার উরাল অঞ্চলে অবস্থিত। জাদুঘরটি জেনারেল কালাশনিকভের জীবনী রচনা করেছে এবং একে-৪৭ আবিষ্কারের দলিলসমূহ হাজির করেছে। কালাশনিকভের যাদুঘর কমপ্লেক্সটি কয়েকটি হলরুমে এবং মাল্টিমিডিয়া প্রদর্শনীর মাধ্যমে একে-৪৭ আঘাতকারী রাইফেলটির বিকাশ হবার রূপটি তুলে ধরে এবং প্রতি মাসে ১০,০০০ দর্শকদের আকর্ষণ করে। জাদুঘরের পরিচালক নাদেঝদা ওয়েচটোমোভা একটি সাক্ষাতকারে বলেছেন যে যাদুঘরটির উদ্দেশ্য আবিষ্কারক এবং কর্মীদের কঠোর পরিশ্রমকে সম্মানিত করা এবং “যারা অস্ত্র তৈরি করছে এবং সেই ইতিহাস আমাদের দেশে বলছে তাদের কাছ থেকে খুনের অস্ত্র হিসেবে অস্ত্রকে পৃথক করা।”
এই অস্ত্রের বিস্তার শুধু বেশী সংখ্যার দ্বারাই প্রতিফলিত হয়। একে-৪৭ মোজাম্বিকের পতাকা এবং তার প্রতীকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, যেটি স্বীকৃতি দেয় যে দেশটি একে-৪৭সমূহের কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে বৃহত্তর অংশে তার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এটি পূর্ব তিমুর বাহিনীর কোটে এবং বিপ্লব যুগের বুর্কিনা ফাসোর পাশাপাশি হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার প্রতিরোধ, ফার্ক-ইপি, নিউ পিপলস আর্মি, তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টি (মা-লে) এবং আন্তর্জাতিক বিপ্লবী গণপ্রজাতন্ত্রী গেরিলা বাহিনীর পতাকাগুলিতেও পাওয়া যায়।
কিছু পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রকারী কুচক্রী সন্ত্রাসবাদী দেশ স্নায়ু যুদ্ধের যুগ এবং ইদানিংকালেও তাদের শত্রুদের সাথে একে-৪৭ কে সংযুক্ত করে দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, পাশ্চাত্যের সিনেমায় প্রায়ই বিভিন্ন বিপ্লবী গ্রুপের সদস্যদের, বিভিন্ন চক্রের সদস্য এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে একে-৪৭সমূহের ব্যবহার হবার চিত্র দেখায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং পশ্চিম ইউরোপের সন্ত্রাসী-পৃষ্ঠপোষক পাশ্চাত্য সিনেমাসমূহে শুধু মিথ্যাচার দেখাতে একে-৪৭-এর ব্যবহার দেখা যায়। বিপরীতভাবে, উন্নয়নশীল বিশ্ব জুড়ে, একে -৪৭কে বৈদেশিক আক্রমণ, সাম্রাজ্যবাদ বা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের সাথে ইতিবাচকভাবে দেখানো হয়।
তথ্যসূত্র:
১. Dmitry Solovyov, “AK-47 rifle inventor Mikhail Kalashnikov dies at 94”. Reuters UK. 24 December 2013. Archived from the original on 14 June 2015. Retrieved 13 June 2015.
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।