ভোট (ইংরেজি: Vote) হচ্ছে সংসদীয় বা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে একটি পক্ষের লোকজনের ভেতরে বিরাজমান কোনো মত বা বিতর্কে কাউকে সমর্থন করার প্রক্রিয়া। পুঁজিবাদী শোষণমূলক রাষ্ট্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোট হচ্ছে আইনসঙ্গত অধিকার। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী যুগের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারে ভোটকে খুব বড় করে দেখানো হয়; কেননা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শাসন, শোষণ ও নির্যাতন চালাতে সরকার পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষকে নির্ধারণ করতে সাধারণ জনগণের ভোট দেবার প্রয়োজন পড়ে। ফলে শ্রেণিভিত্তিক সমাজে রাজনৈতিক সম্মতিকারক ভোট (ইংরেজি: Approval voting) হচ্ছে জনগণকে শাসন, শোষণ ও নির্যাতনকারী কর্তৃপক্ষ নির্ধারণের একটি আইনসংগত প্রক্রিয়া।
আঠারাে শতকের শেষ থেকে পশ্চিমি অনেক দেশে ভােটদানের অধিকার ক্রমে সম্প্রসারিত হয় এবং বিশ শতকের শেষ দশকে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নরনারী নির্বিশেষে বয়স্ক ব্যক্তিদের ভােটাধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে দেশ ও কালভেদে এই অধিকারের নানারকম শর্ত দেখা যায়।
যুক্তরাজ্যে উনিশ শতকে ভােটাধিকারের ন্যূনতম শর্ত ছিল স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা। বিশ শতকে প্রথম বিশ্ব-মহাযুদ্ধের পর সেখানে সকলেই ভােটাধিকার পায় এবং নারীদের যে সীমিত অধিকার তখন প্রদত্ত হয়েছিল সেটাও ১৯২৮ খ্রি মধ্যে সর্বাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র সুইজারল্যান্ডে নারীদের হাল আমল অবধি ভােটাধিকার ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ভােটদাতার বয়স অন্যূন আঠারাে বছর। ভারতে ১৯৩৫ খ্রি ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সাক্ষরতা, কর প্রদান ও সম্পত্তির মালিকানার ভিত্তিতে শতকরা ১৩ জন ভােটাধিকার পায়। স্বাধীন ভারতে সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার অন্যূন ২১ বছর বয়স্ক ব্যক্তিদের দেওয়া হয়। ১৯৮৯ খ্রি থেকে ভােটদাতার ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরে নামানাে হয়েছে।[১]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ভোট সাম্রাজ্যবাদীদের নীতিতে পরিণত হয়। ফলে কমিউনিস্টদের প্রধান নীতি ভোটের বিরোধিতা করা। ভোট বিরোধিতা করা মানেই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা করা, কেননা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো নিপীড়িত দেশগুলোতে চায় একটা গ্রহণযোগ্য ভোট পদ্ধতি যাতে অনেকগুলো বুর্জোয়া পার্টি অংশ নিতে পারে। ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় ভোট, নির্বাচন (ইংরেজি: Election/Selection), সমর্থন (ইংরজি: Suffrage, ফরাসি: Franchise) মোটামুটি এই তিনটি বিষয় আছে। কমিউনিস্টদের পার্লামেন্ট ধরনের ভোটের বিরোধীতা করাই উচিত। কমিউনিস্ট পার্টিতেও অজস্র নির্বাচন পদ্ধতি আছে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা প্রয়োগের জন্য নির্বাচন প্রয়োজন পড়ে। আমরা নির্বাচনের বিরোধী নই।
অন্যদিকে গণতন্ত্র হচ্ছে সামন্তবাদ, প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্র ও জমিদারতন্ত্রসহ অন্যান্য পরজীবী শ্রেণিগুলোর উৎখাত; জমির উপর কৃষকের পরিপূর্ণ মালিকানা। সেই গণতন্ত্রের কথা এখন আর কেউ বলে না।
কিন্তু গণতন্ত্রের শত্রুরও অভাব নেই। যেমন তেমন একজন গণতন্ত্রবিরোধী লেখক হচ্ছেন আলতাফ পারভেজ। তিনি বামপন্থীদেরকে সাম্রাজ্যবাদদের অধীন মুৎসুদ্দিদের দ্বারা চালিত নির্বাচনে ঠেলে দিতে চান। তিনি ২৬ নভেম্বর ২০১৮ গণবিরোধী প্রথম আলোর এক লেখায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে কমিউনিস্ট ইশতেহারের একটি মন্তব্যকে টেনে আনলেন এই বলে যে, ‘শ্রমিকশ্রেণিকে গণতন্ত্রের সংগ্রামেও জিততে হবে। এটাই তার সংগ্রামের প্রথম ধাপ।’[২] কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ইশতেহারে এই কথা বলেছিলেন যখন বুর্জোয়ারা সামন্তবাদকে কচুকাটা করছিল গোটা ইউরোপজুড়ে, পুঁজিবাদের রাস্তাকে প্রশস্ত করছিল, দেশে দেশ প্রলেতারিয়েতের সংখ্যাকে বাড়িয়ে তুলছিল, রাজতন্ত্রের অবশেষকে গলা টিপে হত্যা করছিল।
কিন্তু আজ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। মূলত বিশ শতকে সাম্রাজ্যবাদী গণতন্ত্রবিরোধী শত্রুরা যুদ্ধ ও শোষণের সাথে পার্লামেন্টারি নির্বাচনকে জনগণের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ভোট সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান নীতিতে পর্যবসিত হয়েছে। ফলে কমিউনিস্টদের প্রধান নীতি ভোটের বিরোধিতা করা। লেনিন এই বিষয়টি রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থে দেখিয়েছেন, তিনি বলেছেন “প্রভু শ্রেণির কোন লোকটি পার্লামেন্টে জনগণকে দমিত ও দলিত করবে, কয়েক বছরে একবার করে তা স্থির করা – এই হলো বুর্জোয়া পার্লামেন্টপ্রথার আসল মর্মার্থ, এবং সেটা শুধু পার্লামেন্টী-নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রেই নয়, সর্বাধিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেও।”[৩]
বিশ্বায়নবাদী বর্তমান বিশ্বে পার্লামেন্টী নির্বাচন জনগণের মুক্তির কোনো কাজেই লাগে না, এটা জনগণের উপর শোষণকে বৈধ করে। এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ভোটের আরো একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশসমূহে সাম্রাজ্যবাদ যেসব সংগঠন তৈরি করে, কখনো এনজিওর রূপে কখনো আন্তর্জাতিক সংগঠনের রূপে, সেসব সংগঠনের কাছে ভোটকে তুলে ধরা হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ারূপে।
সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যম অনবরত প্রচার করে ভোট হওয়া মানেই সেইসব দেশ গণতান্ত্রিক। যেমন বাংলাদেশে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বামপন্থীরা অংশ নিলে, সব আন্তর্জাতিক সংগঠন, ডেমোক্রেসি ওয়াচ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকারীদের কাছে এই নির্বাচনের বৈধতা তৈরি হবে। ঘটনাটি এমন বামপন্থিরাসহ দুচারটি সংগঠন ভোটে নামার অর্থই আন্তর্জাতিকভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনকে সাম্রাজ্যবাদীরা গ্রহণযোগ্য বলে প্রচার করার সুযোগ নেবে। সহজ কথায় এই নির্বাচনে বামগণতান্ত্রিক জোট অংশ নেয়ার অর্থ হচ্ছে বাম জোট সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকে বৈধতা দিল। ইতিমধ্যেই বাম জোট নির্বাচনে অংশ নিয়ে সাম্রাজবাদী কার্যকলাপকে সমর্থন দিয়ে বসেছে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশে বামপন্থীদের সুবিধাবাদী অংশটি অনবরত নির্বাচনের পক্ষে কথা বলে লেনিনবাদ ও মার্কসবাদকে চুলোয় ঢুকাচ্ছেন। শুধু আলতাফ পারভেজ নয়, যেমন কয়েকদিন আগে কমরেড বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, “সর্বস্তরের জনগণ, ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবিদের প্রতি আহবান জানাতে হবে, তারা যেন ভোটের দিন ভোট কেন্দ্র পাহারায় রাখে।”[৪] ভোট প্রসঙ্গে তিনি একই সংবাদ সম্মেলনে আরো বলেছেন যে, “সুষ্ঠু নির্বাচন না হলেতো সামরিক সরকার বা একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় চলে আসে। তাই একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমরাও চাই।”[৪]
লেনিন স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কে কি বলেছেন তা একটু দেখি। লেনিন বলেছেন যে, “সামন্তবাদ, স্বৈরতন্ত্র ও বিজাতীয় নিপীড়নের উচ্ছেদ হবার আগে সমাজতন্ত্রের জন্য প্রলেতারীয় সংগ্রাম বিকাশের কোনো কথাই উঠতে পারে না।”[৫] লেনিন যেখানে গণতন্ত্রের সংগ্রামকে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ উৎখাতের সাথে সম্পৃক্ত করেন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইয়ে বহুবার দেখান যে সাম্রাজ্যবাদের যুগে কেবল প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েম মারফত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব, সেখানে বাংলাদেশের বাম-গণতান্ত্রিক জোট, আলতাফ পারভেজ এবং বদরুদ্দীন উমর সেখানে স্বৈরতন্ত্রীদের দ্বারা চালিত ভোটের মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার প্রতিরোধের দিবাস্বপ্ন দেখেন। হায় সেলুকাস!!
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৩২।
২. দেখুন, আলতাফ পারভেজ, ২৬ নভেম্বর ২০১৮, “নির্বাচন ডেটলাইন তোপখানা রোড” দৈনিক প্রথম আলো, https://www.prothomalo.com/opinion/article/1566875/
৩. লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব
৪. বদরুদ্দীন উমর, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ “‘বর্তমান সরকারের পরিণতি মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্টের চেয়েও খারাপ হবে’” দৈনিক নয়া দিগন্ত, dailynayadiganta.com/politics/352399/’
৫. লেনিন, সমাজতন্ত্র ও যুদ্ধ, জুলাই-আগস্ট, ১৯১৫।
রচনাকাল ২৭ নভেম্বর ২০১৮
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।