প্রাচীন এবং মধ্যযুগের বিজ্ঞানে ঈথার (ইংরেজি: Aether) উপাদানটি হচ্ছে মহাবিশ্বের এমন জিনিস যা পৃথিবীর গ্যাসীয় অংশের উপর থেকে চন্দ্রনিম্নস্থ অঞ্চলটি পরিপূর্ণ করে। অন্য কথায় প্রাচীন ও মধ্যযুগে মহাশূন্যে পরিব্যাপ্ত পদার্থ বিশেষকে ঈথার নামে আখ্যায়িত করা হত।
পৃথিবীর নিকটমণ্ডলে বাতাস আছে। কিন্তু যত ঊর্ধ্বে যাওয়া যায়, তত বাতাস হ্রাস পেয়ে এক পর্যায়ে শূন্য হয়ে যায়। এ অভিজ্ঞতা প্রাচীন মানুষেরও ছিল। অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্নের উদ্ভব হয় যে, পৃথিবীর অতি ঊর্ধ্বের বায়ুহীন স্তর কি পদার্থহীন শূন্যতা, না মাটি, জল, বায়ু, আগুন এই পরিচিত পদার্থের অতিরিক্ত অপর কোনো পদার্থের অস্তিত্ব সেখানে রয়েছে। জগতের কোথাও বস্তুহীন শুন্যতা যে বিরাজ করতে পারে না, এ ধারণা কেবল আধুনিক বিজ্ঞানের নয়, প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞানীদের রচনাতেও এ ধারনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। গ্রিকগণ প্রথমে মনে করত যে, পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকও বায়ুশূন্য নয়। তবে অতি ঊর্ধ্বের বায়ু অতিরূপে পরিশুদ্ধ। আর এ বায়ুর জীবন আছে এবং সে স্বর্গীয়।
মহাশুন্যের ব্যাখ্যা প্রথমে দেন দার্শনিক এনাক্সাগোরাস (৫০০-৪২৮ খ্রি. পূ.)। তিনি বলেন, বিশ্বের বহির্মণ্ডলে ঈথার পরিব্যাপ্ত এবং শুন্যতা বলে বিশ্বের কোথাও কিছু নেই। ডিমোক্রিটাস তাঁর অণুতত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলেন, শুন্যতা যে নেই তা নয়। শূন্যতা ঈথাররূপ অণু দ্বারা পূর্ণ। এই ঈথার অণুর গতির মাধ্যমেই গ্রহ এবং তারকারাজির আবর্তন সম্ভব হচ্ছে। এ্যারিস্টটল ঈথারকে বায়ু, অগ্নি, পানি এবং মাটির সঙ্গে পঞ্চম পদার্থ বলে অভিহিত করেন।
সপ্তদশ শতকের দার্শনিক এবং অঙ্কবিদ রেনে দেকার্ত বস্তুর আলোচনায় বলেন, বস্তুর মৌলিক চরিত্র হচ্ছে স্থানিক। অর্থাৎ স্থানের মধ্যে বস্তুর আলোচনায় বলেন, বস্তুর মৌলিক চরিত্র হচ্ছে স্থানিক। অর্থাৎ স্থানের মধ্যে বস্তু পরিব্যাপ্ত। এ অভিমতের একটি গভীর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য ছিল। এর ফলে কোনো স্থানকে আর মানুষের পক্ষে বস্তুশূণ্য বলে কল্পনা করা সম্ভব হলো না। স্থান মানে বস্তু, তবে মহাশূন্যের বস্তু থেকে সূক্ষ্মতর বলে কল্পনা করেছিলেন।
পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকে বাতাস নেই। কিন্তু সেই বায়ুশূন্য অতিক্রম করেও সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছে। আলো কোনো মাধ্যম ব্যতীত এই পথ অতিক্রম করতে পারে না। কাজেই মহাশূন্যে কোনো মাধ্যম অবশ্যই আছে। কিন্তু সে মাধ্যম জল, বায়ু বা ধাতব কোনো পদার্থ হতে পারে না বলে এই অনস্বীকার্য মাধ্যম ঈথার বলে আধুনিক বিজ্ঞানেও অভিহিত হয়েছে। তবে পদার্থ বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তে মহাশূন্যকে ঈথারমণ্ডল না বলে একটা বস্তুক্ষেত্র বলে অভিহিত করা হয়।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৫৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।