উপমা, সাদৃশ্য, সাদৃশ্যানুমান (ইংরেজি: Analogy) হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বিষয় থেকে অন্য কোন বিষয়ে তথ্য বা অর্থ স্থানান্তরের একটি জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া, বা এমন একটি প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত ভাষাগত অভিব্যক্তি। ইংরেজী ‘এ্যানালজি’ শব্দ গ্রিক শব্দ ‘এ্যানালজিয়া’ থেকে উদ্ভুত। এ্যানালজিয়ার অর্থ হচ্ছে অনুপাত। প্রাচীনকালে অনুপাতের সমতা বা সাদৃশ্য অঙ্কশাস্ত্রে সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু কেবল অনুপাতের সমতা নয়, দুইটি বিষয়ের মধ্যে কিছু পরিমাণ গুণের সাদৃশ্যের ভিত্তিতেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা চলে।
ইনডাকটিভ বা আরোহ যুক্তিতে সাদৃশ্যানুমান যুক্তির একটি পদ্ধতি। সাদৃশ্যানুমানের পদ্ধতিটি এরূপ ক এবং খ কে পারস্পারিকভাবে তুলনা করা হলো। দেখা গেল ক-এর ত,থ,দ,ধ নামক গুণ রয়েছে; খ-এরও থ,দ,ধ গুণ। ক-এর গুণের কিছু সংখ্যকের সঙ্গে খ-এর গুণের উক্ত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা চলে যে, খ-এর মধ্যে অপর অর্থ্যাৎ ‘ত’ গুণ গুণটিও থাকতে পারে।
সাদৃশ্যানুমানের এই গঠন থেকে বুঝা যায়, এরূপ সিদ্ধান্তে বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তা থাকে না। সিদ্ধান্তটি সঠিক হতে পারেও আবার না-ও হতে পারে, এরূপ একটা অনিশ্চিত অবস্থার অবকাশ এরূপ অনুমানের মধ্যে থেকে যায়। এ কারণে সাদৃশ্যানুমানকে সঠিক পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গৃহীত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু সাদৃশ্যানুমানকে পুরোপুরি বাতিল করাও চলে না। মানুষের জ্ঞানের অনুন্নত পর্যায়ে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে অনুমান একটি অপরিহার্য পদ্ধতি হিসাবে স্বীকৃত ছিল। এরূপ অনুমানের উপর নির্ভর করে প্রাথমিকভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত গবেষণার পরবর্তী পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সাদৃশ্যানুমান জ্ঞানের প্রাথমিক সুত্র হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ।
একটি সাদৃশ্যানুমান কম-বেশি পরিমাণে নিশ্চিত হতে পারে। নিশ্চয়তার পরিমাণ নির্ভর করে উপমিত বস্তুদ্বয়ের পারস্পারিক সাদৃশ্যের সংখ্যা এবং চরিত্রের উপর। সিন্ধান্তের নিশ্চয়তা বৃদ্ধির জন্য লক্ষ্য রাখতে হবে যেন উপমিত বস্তদ্বয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাদৃশ্য থাকে; উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্যের পরিমাণ বৈসাদৃশ্যের চেয়ে অধিক হয় উপমা দুইটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উপমা বা সাদৃশ্যের অসতর্ক ব্যবহার ভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। জননী এবং জন্মভূমির মধ্যে কিছু সাদৃশ্র আছে। ‘জননী সন্তানকে লালন পালন করে; জন্মভূমিও তার অধিবাসীর জীবনধারণের আবাস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সন্তান অসুস্থ হলে জননী তার শুশ্রুষা করে। সুতরাং জন্মভূমির অধিবাসী অসুস্থ হলে জন্মভূমিকে তার শুশ্রুষা করে হবে।’ এখানে জন্মভূমিকে জননীর সঙ্গে রূপকার্থে সদৃশ মনে করা হয়েছে। এরূপ সাদৃশ্যানুমান যথাযথভাবে সঠিক হতে পারে না।
সাদৃশ্যানুমানকে নিশ্চিত করার জন্য পরবর্তী পর্যায়ে উপযুক্ত গোবষণার ভিত্তিতে এর সত্যাসত্যতা পরীক্ষা করা আবশ্যক। নচেৎ, এরূপ অনুমান নিছক অপ্রমাণিত অনুমানেই সীমাবদ্ধ থাকে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৫২-৫৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।