উদাসীনতাবাদ হচ্ছে জীবনের আরাম আয়েশ সব কিছুর প্রতি কঠোর ঔদাসীন্য

জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আরাম আয়েশ সব কিছুর প্রতি একটা কঠোর ঔদাসীন্য বুঝাতে ইংরেজী ‘সিনিক’ এবং ‘সিনিসিজম’ (ইংরেজি: Cynicism) শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়। আরো পড়ুন ইংরেজি সিনিক শব্দের উদ্ভব গ্রিক ‘কিওনস’ থেকে। ‘কিওনস’ বলতে কুকুর বুঝায়। আর তাই ‘কিনিকাল’ বা ‘সিনিকাল’ দ্বারা কুকুরের ন্যায় অদমনীয় মনোভাব বুঝাত।

কিন্তু এই শব্দের দার্শনিক তাৎপর্য গ্রিক দার্শনিক এ্যান্টিসথেনিস (খ্রি. পূ. ৪৩৫-৩৭০) এবং তাঁর অনুসারী ডায়োজেনিস, ক্রেটিস প্রমুখ দার্শনিকদের জীবন দর্শন এবং জীবনাচার থেকে উদ্ভুত। দাসদের শোষণের ভিত্তিতে গ্রিক গণতন্ত্র এককালে যে শৌর্য এবং বীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন গ্রিক নগর রাষ্ট্রের আত্মঘাতী সংঘর্ষে সে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সমাজে অবিশ্বাস, অন্তর্ঘাত এবং নৈরাজ্যের সৃষ্টি করতে থাকে। সমাজের এই অস্থির অবস্থায় এমন একদল চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের উদ্ভব ঘটে যাঁরা মানুষের শান্তি সামাজিক ও রাজনীতিক ক্রিকাকাণ্ডে অংশগ্রহণে নয়, সমস্তরকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং জীবনের আরাম আয়েশ বিলাস ব্যসন সব কিছু পরিত্যাগের মধ্যে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। উদাসীনতাবাদ মনোভাবের প্রাথমিক লক্ষণ মহৎ ব্যক্তি সক্রেটিসের জীবনাচরণ এবং অভিমতের মধ্যে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব নয়, জ্ঞানের অন্বেষণ এবং সহজ জীবনযাপনের মধ্যেই তিনি ব্যক্তির মহৎ কর্তব্য নির্দিষ্ট করেছিলেন।

সহজ জীবন যাপনের সক্রেটিসীয় নীতি সিনিকপন্থীগণ অধিকতর কঠোরভাবে অনুসরণ করার জন্য জীবনের প্রায় সব প্রয়োজনকে বাহুল্য বলে বর্জন করার চেষ্টা করে। ‘অঞ্জলিদে যদি তৃষ্ণার পানি পান করা সম্ভব তা হলে পেয়ালা বাহুল্য। অতএব সে বর্জনীয়’। সিনিক দার্শনিক ডায়োজেনিস (খ্রি. পূ. ৪১২-৩২৩) সম্পর্কে এরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে যে, গ্রিক সম্রাট আলেকজাণ্ডার একদিন ডায়োজেনিসের নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন। ডায়োজেনিস তখন সূর্যালোকে উপবিষ্ট। সম্রাট আলেকজাণ্ডার সূর্যের রশ্মিকে আড়াল করে ডায়োজেনিসের নিকটবর্তী হয়ে যখন দার্শনিককে বললেন, ‘আমি আপনার কি উপকার করতে পারি?’ তখন দার্শনিক উত্তরে বললেন, ‘আপনি আমার উপর নিপতিত সূর্যের রশ্মিকে আড়াল না করে একটু সরে দাঁড়াতে পারেন।

আরো পড়ুন:  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পশ্চিম রণাঙ্গন ছিল ইউরোপের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র

সিনিক দার্শনিকদের সবকিছু বর্জন করার নীতির একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল। শোষণ এবং অনাচারপূর্ণ তৎকালীন গ্রিক সমাজের সবকিছু বর্জন করে জ্ঞানের মধ্যে মুক্তি অন্বেষণের নীতিকে সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও শোষণের সমালোচনা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়। উদাসীনতাবাদ দার্শনিকগণ সমাজে দাস ও প্রভুর বৈষম্যকে স্বীকার করত না। সকল মানুষ সমান, এই মতাদর্শ তারা অনুসরণ করত। এই আদর্শ তৎকালীন মানুষের দৃষ্টিকে গ্রিক নগর রাষ্ট্রের সংকীর্ণ প্রাচীর অতিক্রম করে বৃহত্তর মনুষ্য সমাজের মধ্যে বিস্তারিত করার সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছিল।

উদাসীনতাবাদ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা এ্যাণ্টিসথেনিস ছিলেন প্লেটোর সমকালীন। তিনি এরূপ অভিমত পোষণ করতেন যে, যিনি জ্ঞানী তাঁর কর্তব্য হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতার সর্বজনীন আদর্শকে অনুসরণ করা। তিনি আরো মনে করতেন, জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানুষ সভ্যতার কৃত্রিমতাকে বর্জন করে যত বেশি পশুর প্রাকৃতিক সহজ জীবনে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে তত সে স্বাভাবিক এবং উত্তম জীবনের অধিকারী হবে। এ্যান্টিসথেনিস ‘সাইনো সারজেম’ নামক স্থানে তাঁর দর্শন প্রচার করতেন। এই স্থান থেকেও ‘সিনিক’ শব্দের উৎপত্তি ঘটে থাকতে পারে। বিভিন্ন গ্রিক দর্শনের সঙ্গে দর্শনের প্রচার স্থানের নাম যুক্ত হতে দেখা যায়। একাডেমীয়া স্থান থেকে প্লেটোর একাডেমী। লাইসিয়াম থেকে এ্যারিস্টটলের লাইসিয়াম দর্শনপিঠের প্রসিদ্ধি।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১২০-১২১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!