সারবাদ বা সমন্বয়বাদ (ইংরেজি: Eclecticism) হচ্ছে তত্ত্বের ক্ষেত্রে একাধিক তত্ত্বের অংশবিশেষ গ্রহণ করে সবটা মিলিয়ে একটা তত্ত্বের আকার দেবার চেষ্টা। জ্ঞানের রাজ্যে বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে একটি মাত্র তত্ত্বই উদ্ভুত হয় নি। একই সমস্যার ব্যাপারে বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও দার্শনিক বিভিন্ন মত উপস্থিত করেছেন।
বস্তু, জীবন, জগৎ প্রভৃতির মূল চরিত্র কি? এ প্রশ্নে বস্তবাদ মনে করে যে, বস্তুই সব কিছুর মূল। অপরপক্ষে ভাববাদ মনে করে মানুষের মনের ভাব কিংবা ব্যক্তির মন নিরপেক্ষ এক চরম ভাবই হচ্ছে সব কিছুর মূল। এ দুটো মত পরস্পর বিরোধী।
সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ মনে করে আর্থিক উৎপাদনেরর ক্ষেত্রে ব্যক্তির অর্থাৎ পুঁজিসম্পন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার অবাধ স্বাধীনতা এবং উদ্যোগই কাম্য। সমাজতন্ত্র মনে করে উৎপাদনের উপায়ের উপর সমষ্টির অধিকারই কাম্য, ব্যক্তিগত মালিকানা অসঙ্গত। এ দুটি মতও পরস্পর-বিরোধী। সাধারণত যে বস্তুবাদী, সে ভাববাদকে গ্রাহ্য করতে চায় না। যে পুঁজিবাদী, সমাজতন্ত্রকে পুরোপুরি নাকচ করে। যে-কোন তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা অনুসারীর পক্ষে এটাই যুক্তিসঙ্গত। কারণ একটি তত্ত্ব সামগ্রিক তত্ত্ব হয়ে ওঠে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতার দাবির ভিত্তিতে।
সাধারণ মানুষ সবসময়ে কোনো একটি তত্ত্বের একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে জীবন যাপন করে না। দৈনন্দিন প্রয়োজনে এবং সমস্যার সাময়িক জবাবে বিভিন্ন তত্ত্বের, এমনকি পরস্পর-বিরোধী তত্ত্বের পছন্দমতো অংশ সে গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। এ প্রবণতা কেবল সাধারণের ক্ষেত্রে নয়। ইতিহাসে প্রখ্যাত অনেক চিন্তাবিদের মধ্যেও বিভিন্ন মত সমন্বয়ের প্রয়াস দেখা যায়। বিভিন্ন মতের সমন্বয়কে একটা প্রবণতা হিসাবে ব্যাখ্যা করাই সঙ্গত।
সর্বমতের সমন্বয় মারফত কোনো ঐক্যবদ্ধ সামঞ্জস্যপূর্ণ তত্ত্ব দাঁড় করানো সম্ভব নয়। যাঁরা এরূপ চেষ্টা করেন, তাঁদের মধ্যে মানুষের কল্যাণ সাধনের একটা সহজ আবেগই বেশি কাজ করে। তাঁরা মনে করেন, সত্য কোনো একটি তত্ত্বের মধ্যে নিহিত না থেকে সমস্ত তত্ত্বেই আংশিকভাবে প্রকাশিত হতে পারে। সত্যসন্ধানীর কাজ হবে সমস্ত ক্ষেত্র থেকে অংশসমূহকে একত্র করে সত্যের একটি সমগ্র-সত্তা তৈরি করা। এরূপ ইচ্ছার মধ্যে কল্পনার প্রকাশই বেশী। ফলে, সমন্বয়বাদী তত্ত্বের একটির সাথে অপরটির সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
সমন্বয়বাদীর মতে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ, বস্তুবাদ ও ভাববাদ একই সময়ে গ্রাহ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। সমন্বয়বাদী মনে করে, সমাজতন্ত্রবাদ এবং পুঁজিবাদ মিলিয়ে সর্বসমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আধুনিককালের ন্যায় দর্শনের ইতিহাসে অতীতকালেও এরূপ সমন্বয়বাদী লেখক ও দার্শনিকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
প্রাচীন রোমের বাগ্মী ও দার্শনিক সিসেরো (১০৬-৪৩ খ্রি পূ.) এরূপ সমন্বয়বাদী বলে প্রখ্যাত। সমন্বয়বাদের মনোভাব থেকে তিনি মতামত-নিরপেক্ষভাবে প্রাচীন গ্রিকদর্শনের সর্বপ্রকার দার্শনিক মতকে রোমকদের কাছে পেশ করার চেষ্টা করেন।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৪২-১৪৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।