প্রচলিত যুক্তিশাস্ত্রে প্রত্যক্ষ অনুমান (ইংরেজি: Immediate Inference) বলতে সেই সিদ্ধান্ত বা অনুমানকে বুঝানো হয় যে অনুমান একটিমাত্র হেতু বা দত্ত বাক্য দ্বারা গৃহীত হয়। যেমনঃ
সকল মানুষ মরণশীল।
অতএব, কোনো মানুষ অমর নয়।
এখানে একটিমাত্র হেতু বাক্য ‘সকল মানুষই মরণশীল’ থেকে সুতরাং ‘কোনো মানুষ অমর নয়’ সিদ্ধান্তটি অনুমান করা হয়েছে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, এই বিশেষ্যটির দত্তবাক্যের বিধেয় পদ মরণশীল এর বিপরীত পদ ‘অমর’কে সিদ্ধান্ত পদের বিধেয় পদ হিসেবে ব্যবহার করে এবং দত্তবাক্য যেখানে ‘হ্যঁ’ বাচক সেখানে সিদ্ধান্ত বাক্যকে ‘না’ বাচক করে অনুমানটি গৃহীত হয়েছে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় আবর্তন বা ইংরেজিতে কনভার্সন। একটিমাত্র বাক্য হতে গৃহীত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আরো কয়েকটি কৌশল বা পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী প্রত্যক্ষ অনুমানকে অবভারশন বা পরিবর্তন, কন্ট্রাপজিশন বা প্রতি আবর্তন প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত করা হয়।
প্রত্যক্ষ অনুমানের বিপরীত হচ্ছে পরোক্ষ অনুমান। অনুমানের প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে পরোক্ষ অনুমান। পরোক্ষ অনুমান একাধিক হেতু বা দত্তবাক্যের ভিত্তিতে একটি অনুমান বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেমনঃ
সকল মানুষ মরণশীল
সক্রেটিস একজন মানুষ
সক্রেটিস মরণশীল।
প্রত্যক্ষ জ্ঞান (ইংরেজি: Immediate Knowledge) বলতে প্রত্যক্ষ অনুমানের ন্যায় কোনোরূপ মাধ্যম ব্যতীত অর্জিত জ্ঞান বুঝানো হয়্। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। জ্ঞানতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পূর্বে প্রত্যক্ষ জ্ঞানকেই জ্ঞানের প্রধান উপায় বলে মনে করা হতো। প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে অভিজ্ঞতালব্ধ প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও বুদ্ধিগত প্রত্যক্ষ জ্ঞান-এ দুই ভাগে ভাগ করা হতো। প্লেটো, দেকার্ত, স্পিনোজা, লাইবনিজ এই সমস্ত দার্শনিক বুদ্ধিগত প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অধিক নির্ভরযোগ্য মনে করতেন। এঁদের মতে অঙ্ক ও জ্যামিতি শাস্ত্রের স্বতঃসিদ্ধগুলি বুদ্ধিগত প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অন্যতম দৃষ্টান্ত। কেননা এই সত্যগুলিকে মানুষ কোনো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্য বলে উপলব্ধি করে না। এগুলি মানুষের সহজাত। মানুষ তার অন্তর্নিহিত বুদ্ধির আলোকেই এগুলি সত্য বলে বুঝতে পারে।
আধুনিককালে জার্মান দার্শনিক হেগেল প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ধারণাটি সমালোচনা করেন। হেগেল পরোক্ষ জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কশূণ্য কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে অসম্ভব বলে মনে করেন। তাঁর মতে জ্ঞান হচ্ছে একটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া। এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ বোধ বা অনুভূতি পরোক্ষ জ্ঞানের সঙ্গে মিলিত হয়ে জ্ঞান-সমগ্রকে তৈরি করে। কিন্তু হেগেলের জ্ঞানতত্ত্বও শেষাবধি বস্তুবাদী থাকে নি। তিনি মনে করতেন যে, বস্তু, ব্যক্তি, সমাজ, ইতিহাস, জ্ঞান সবই পরস্পর সম্পর্কিত এবং সবটা মিলিয়ে যে সত্তা তা হচ্ছে ভাব, বস্তু নয়। কেননা ভাব বা জ্ঞানের মাধ্যমেই সে বোধ্য, অন্য কোনো উপায়ে নয়।
জ্ঞানতত্ত্বের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হেগেলের বস্তুবাদী ধারার অনুসরণকারী মার্কসবাদীগণের ব্যাখ্যাত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে। এই মত অনুযায়ী অভিজ্ঞতা এবং প্রমাণের উর্ধে্ব প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলে বস্তুজগতের জ্ঞানলাভের কোনো উপায় থাকতে পারে না। যাকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা হয় সে হচ্ছে মানুষের যুগ যুগ অনুসন্ধান, অভিজ্ঞতা ও প্রমাণের ভিত্তিতে লব্ধ জ্ঞান যা আর কোনো নতুন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২১২-২১৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।