বিশ্বাসবাদ বিশ্বাস করে, যুক্তি নয়, বিশ্বাস দ্বারাই মানুষ চরম সত্যকে লাভ করতে পারে

বিশ্বাসবাদ (ইংরেজি: Fideism) বলা হয় সেই মতবাদকে যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে, যুক্তি নয়, বিশ্বাস দ্বারাই মানুষ চরম সত্যকে লাভ করতে পারে। শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, দর্শনের ক্ষেত্রেও বিশ্বাসবাদের প্রকাশ দেখা যায়। বিশেষ করে ভাববাদী দর্শনের মৌলিক কোনো প্রশ্নের সমাধানে পরিণামে বিশ্বাসের আশ্রয় গ্রহণ একটি সাধারণ সত্য। ধর্মীয় বিশ্বাসেরও কিছু রকম-ভেদ দেখা যায়। এর একটি প্রকাশকে চরম বিশ্বাস বলা যায়। চরম বিশ্বাস যুক্তিবিরোধী। চরম বিশ্বাস বিজ্ঞানের সার্থকতা অস্বীকার করে। এজন্য চরম বিশ্বাসবাদ যুক্তিবিরোধী।

অস্তিত্ববাদী দর্শনের বিশ্বাসবাদী কিয়ের্কেগার্ড এবং অন্যান্য দার্শনিক অ-যুক্তি বা যুক্তির ঊর্ধ্বে কোনো মাধ্যমকে চরম জ্ঞানের উপায় বলে মনে করেন। এঁদের একটি কথা আছে ‘যা অবিশ্বাস্য তাকেই আমি বিশ্বাস করি’। এর অর্থ, বিশ্বাস্য হচ্ছে সাধারণ। অবিশ্বাস্য হচ্ছে অসাধারণ। আর অসাধারণের মধ্যেই সত্য, সাধারণের মধ্যে নয়। কিন্তু সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায় ধর্মীয় দার্শনিকগণ যুক্তির তাৎপর্য পুরাপুরি অস্বীকার করেন না। এ জন্য তাঁদের মতকে নরমপন্থী বিশ্বাসবাদ বলা হয়। সেণ্ট অগাস্টিন বলতেন, বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আমরা সত্যের অনুসন্ধান শুরু করি। কিন্তু অনুসন্ধানের শেষে দেখতে পাই যে, কেবল যুক্তিতে চরম সত্য লাভ সম্ভব নয়। বিশ্বাসেই চরম সত্য লাভ করা যায়। দর্শনের বিশ্বাসবাদ সাক্ষাৎভাবে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত না হতে পারে।

অজ্ঞেয়বাদী হিউম বলতেন মানুষ বস্তু, কার্যকারণ, স্থানকাল কোনো কিছুর অস্তিত্বই জানতে পারে না। মানুষ কেবল বিশ্বাস করে যে, এসব সত্যের অস্তিত্ব আছে। জর্জ সান্তায়ানা মনে করতেন যে, মানুষের অস্তিত্বের মূল বিশ্বাস তা না যুক্তিগত, না ধর্মীয়। কতকগুলি মৌলিক জান্তব বিশ্বাস বা ধারণার উপর মানুষ জীবনযাপন করে।

বার্ট্রাণ্ড রাসেল মনে করতেন যে, বিশ্বাসই পুরোপুরি করা মানুষের অসাধ্য। বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলির ভিত্তিও বিশ্বাস, যুক্তিগত প্রমাণ নয়। দ্বন্দ্বমূলক বা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বিশ্বাসকে অস্বীকার করে না সত্য। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে বিশ্বাস হচ্ছে জ্ঞানের সদা বিকাশমান প্রক্রিয়ার একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। কিন্তু তাই বলে যুক্তি এবং বাস্তব অনুসন্ধানের বাইরে জ্ঞান লাভের বিশ্বাসরূপ কোনো অনন্যনির্ভর মাধ্যম থাককে পারে না। অভিজ্ঞতা-ঊর্ধ্ব বিশ্বাস আকর, জ্ঞানলাভের কোনো মাধ্যম নয়।

আরো পড়ুন:  ইতিহাসের ভাববাদী ব্যাখ্যা হচ্ছে মহামানব, বা অতিপ্রাকৃত বিধাতার ইচ্ছাতে পরিবর্তন

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৭৩-১৭৪ ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!