অসীমতা হচ্ছে বস্তুজগতকে সামগ্রিকভাবে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজনীয় একটি সূত্র

অসীমতা (ইংরেজি: infinity) হচ্ছে বস্তুজগতকে সামগ্রিকভাবে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজনীয় একটি সূত্র। দর্শনের ইতিহাসে অসীম ও সসীম ভাব দুটি বিশেষ বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। অনেক দার্শনিকের মতে অসীম ও সসীমের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট করার সমস্যা একটি চিরন্তন সমস্যা এবং এর সমাধান সম্ভব নয়। অনেকে আবার অসীমকে একেবারে অস্বীকার করেন। তাঁদের মতে মানুষ অভিজ্ঞতায় কেবল সসীমকেই পায়, অসীমকে নয়। এ কারণে অসীম বলে কিছু আছে বলে মানুষ দাবি করতে পারে না।

অসীমের ধারণা মানুষ তার জীবনের শুরুতে করতে পারে নি। অসীমের ধারণা নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে জন্মলাভ করে নি। সসীম বা খন্ডবস্তুর সঙ্গেই তার প্রথম পরিচয়। কিন্তু খন্ডবস্তুর অভিজ্ঞতা যত বিস্তার লাভ করতে থাকে তত মানুষের মনে বস্তু ও বিশ্বজগতের ব্যাপকতার বোধ জাগ্রত হতে থাকে। এই ব্যাপকতা বোধ থেকেই মানুষের মনে অসীম ভাবের সৃষ্টি হয়েছে।

‘অসীম’ মানুষের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা নয়। ‘অসীম’ একটি যৌক্তিক ভাব। বস্তুকে সসীম ভাবা যায়না বলেই মানুষকে অসীমের কল্পনা করতে হবে। খন্ডবস্তুর সঙ্গে মানুষের পরিচয়। সমস্ত খন্ডবস্তু নিয়ে অখন্ড বিশ্ববস্তু। কিন্তু এমন চিন্তা করা যায় না যে, কাল বা স্থানের মধ্যে এই অখন্ড বিশ্ববস্তুর কোনো সীমানা আছে। যদি তেমন কোনো সীমানা থাকে তাহলে সেই সীমানার বাইরে বিস্তারিত যা তার চরিত্র নির্ধারণ করতে হয়। সীমানার বাইরে যা তা নিশ্চয়ই কোনো অস্তিত্ব। কেননা, অস্তিত্বহীনতার মধ্যে কোনো অস্তিত্ব বিরাজ করতে পারে না। নিরেট শূণ্য বা নাস্তিত্ব বলতে কিছু থাকতে পারে না। নাস্তিত্বের মধ্য থেকে কোনো অস্তিত্ব আবির্ভুত হতে পারে না। কাজেই বস্তুর কোনো সীমানা নির্দিষ্ট করলে তার বাইরে সীমাহীনতাও একটি অস্তিত্ব। আর তা বস্তু ছাড়া কিছু হতে পারে না।

বস্তু ছাড়া কোনো অস্তিত্বের কল্পনা বিজ্ঞান করে না। এ কারণে বস্তুর সীমানার বাইরেও বস্তু। অর্থাৎ বস্তু সীমাহীন ও সময়হীন। বস্তুর মধ্যে সীমা আছে অর্থাৎ সীমাবদ্ধ বস্তুপুঞ্জ দিয়েই বস্তু গঠিত; কিন্তু সমগ্র বস্তুর কোনো সীমা নেই। বস্তুর সময় নেই অর্থাৎ বস্তু কোনো এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে শূণ্যতা ছিল এমন কল্পনাও বৈজ্ঞানিকভাবে করা সম্ভব নয়। কিন্তু খন্ডবস্তুর সময় আছে, পরিবর্তন আছে। খন্ডবস্তুর জন্ম ও পরিবর্তনকে চিহ্নিত করা চলে। কিন্তু সমগ্র বস্তুর নয়।

আরো পড়ুন:  জনগণতন্ত্র হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে সাম্যবাদ প্রভাবিত রাষ্ট্রব্যবস্থা

এ আলোচনা হতে বুঝা যায় যে, সসীম হচ্ছে একটি আপেক্ষিক ধারণা এবং অসীম ও সসীমের সম্পর্ক হচ্ছে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। সসীম দিয়েই অসীম তৈরি। কিন্তু সে কারণে অসীমকে সসীম বলা যায় না। আবার কোনো সসীমই অপর সসীম হতে বিচ্ছিন্ন নয়। খন্ডবস্তুর সঙ্গে খন্ডবস্তুর সম্পর্ক একটি খন্ডবস্তুর সসীমতা যেমন নির্দিষ্ট করে তেমনি আবার এই অচ্ছেদ্য সম্পর্ক তাকে অসীমের অংশ করে অসীমের কল্পনাকে সম্ভব করে তোলে। অসীম ও সসীমের এই পারস্পরিক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে আধুনিককালের হেগেলের দর্শনে এবং তাঁর পরবর্তীকালে মার্কসবাদী দর্শনে পাওয়া যায়।

ধর্ম অবশ্য অসীমকে বস্তু বলে কল্পনা করে না। ধর্মীয় বিশ্বাসে বস্তুজগত হচ্ছে সসীম, কিন্তু বস্তুজগতের স্রষ্টা যিনি তিনি যেমন অ-বস্তু তেমনি অসীম। ধর্মের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এই যে, সেই অসীম অবস্তুকে বস্তুগত গুণ বা ধারণা ছাড়া অপর কিছুর দ্বারা ধর্ম প্রকাশ করতে পারে না। ধর্মীয় অসীম বস্তু হলেও তাঁর দয়া-মায়া, দন্ডদানের এবং সৃষ্টি ও ধ্বংসের ক্ষমতা আছে। ধর্মীয় অসীমের মধ্যে মানুষ মাত্রেরই অসীমবোধের একটা প্রয়োজনীয়তার যেমন স্বীকৃতি আছে তেমনি সে ব্যাখ্যা রহস্যময় হয়ে সসীম ও অসীম উভয়ের বৈজ্ঞানিক ধারণার বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

আলোকচিত্রের ইতিহাস: লেখায় ব্যবহৃত চিত্রটিতে স্বপ্নে অসীমতাকে দেখানো হয়েছে। আলোকচিত্রটি তুলেছেন Porsche Brosseau.

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২২৫-২২৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!