কোনো শ্রেণি বা তার স্তরের সর্বাপেক্ষা সক্রিয় ও সংগঠিত অংশ হচ্ছে দল বা পার্টি বা রাজনৈতিক দল (ইংরেজিতে Political Party)। রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব জড়িত সমাজের শ্রেণিবিভক্তি ও এইসব শ্রেণির বহুবিভাগের সংগে, শ্রেণিসমূহের এবং তার অঙ্গদলগুলোর স্বার্থের পার্থক্যের সংগে। রাজনৈতিক দল হলো গুরুত্বপূর্ণ সেই হাতিয়ার যার সাহায্যে শ্রেণি তার স্বার্থের জন্য, ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম করে। আধুনিক সমাজের শ্রেণিকাঠামো ভেদে পার্টিও বিভিন্ন ধরনের হতে পারে_বুর্জোয়া, প্রলেতারিয় বা শ্রমিক শ্রেণির, সামন্তবাদি, কৃষক, ক্ষুদে-বুর্জোয়া ও অন্যান্য।
অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের সাথে রাজনৈতিক দলের পার্থক্য এখানেই যে, তা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত হয় এবং ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টায় সমাজের রাজনৈতিক জীবন ও সংগঠনে নেতৃত্বসুলভ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।[১]
রাজনৈতিক দল-এর উদ্ভব শ্রেণি সমাজ বিকাশের আদি পর্যায়ের সংগে জড়িত। রাজনৈতিক পার্টি হলো শ্রেণি সংগঠনের সর্বোচ্চ রূপ। বর্তমান সমাজে শুধু শ্রেণি-কাঠামোভিত্তিক পার্টিই নয়, জোটবদ্ধ শ্রেণির স্বার্থবাহক পার্টিও হয় যেমন, বুর্জোয়া-জমিদার পার্টি এবং প্রলেতারিয় ও পেটি-বুর্জোয়া ব্লকের পার্টি। ধর্মীয়সহ অন্যান্য পার্টিও হতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাদের ক্রিয়াকলাপের ভিত্তিতে থাকে শ্রেণি স্বার্থ। অন্তত আধুনিক সভ্য দেশগুলোতে শ্রেণিরা সাধারণত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, পরিচালিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। এই বিষয়ে লেনিন লিখেছেন,
“সাধারণ নিয়ম হিসেবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে চালায় সর্বাধিক প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন, প্রভাবশালী, অভিজ্ঞ, দায়িত্বশীল পদে নির্বাচিত, নেতা বলে অভিহিত লোকদের কমবেশি পাকাপোক্ত এক-একটা গোষ্ঠী। এসবই অ-আ-ক-খ। এসবই সহজ এবং পরিষ্কার।”[২]
উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপ জুড়ে রাজনীতির পার্টি বিভিন্ন মডেল খাপ খাইয়ে নেয়। জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং অন্যত্র, ১৮৪৮ সালের বিপ্লব উদারপন্থী মনোভাবের উত্থান ঘটায় এবং প্রতিনিধি সংস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সৃষ্টিতে স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছিল। শতাব্দীর শেষদিকে ইউরোপের বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক দলগুলির গঠন, কিছু দল নিজেদের কার্ল মার্কসের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে গড়ে ওঠে, অন্যরা সংস্কারবাদী ও ক্রমান্বয়িক পদ্ধতির ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজ গণতন্ত্রকে নিজেদের কর্মকাণ্ডের ভিত্তি হিসেবে অভিযোজিত করে।
আধুনিক রাজনৈতিক পার্টিগুলোর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কর্মসূচি থাকে, সুনির্দিষ্ট নীতি (পলিসি) অনুসরণ করে, তাদের থাকে সাংগঠনিক নীতি ও তদনুযায়ি অভ্যন্তরীণ সংগঠন, নিয়মাবলী, সভ্যদের গঠন, স্থানীয় পার্টি সংগঠন, কমিটি, কংগ্রেস, সদস্য চাঁদা ইত্যাদি। আধুনিক রাজনৈতিক পার্টির সাধারণত থাকে নিজস্ব সংবাদপত্র ও প্রকাশালয়, লোকসভা ও স্থানীয় সংস্থাগুলোতে নিজেদের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে ন্যূনাধিক সংগঠিত নিজেদের পক্ষভুক্ত গ্রুপ।[৩]
নিজস্ব নীতি বা লাইনের অনুশীলনের জন্য, উনিশ এবং বিশ শতক থেকে, অনেক জাতীয় রাজনৈতিক দল নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহে ঐক্যবদ্ধ হবার চেষ্টা করে। এসব সংগঠনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলও ইউনিভার্সাল পার্টি, প্রথম আন্তর্জাতিক, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বা সমাজতন্ত্রী আন্তর্জাতিক, তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক এবং চতুর্থ আন্তর্জাতিক যেগুলো মূলত শ্রমিক শ্রেণির পার্টি করেছে। ১৯৪৫ সালে ইতালিতে গঠিত, দ্য ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিস্ট পার্টি, যার সদর দপ্তর ১৯৭৪ সাল থেকে ফ্লরেন্সে, ছয়টি দেশে তাদের শাখা রয়েছে।
এছাড়াও উদার আন্তর্জাতিক, হিজবুত তাহরির, খ্রিস্টান গণতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক, আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রী ইউনিয়ন হচ্ছে কয়েকটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মপন্থিদের আন্তর্জাতিক সংগঠন। ইংল্যান্ডের ধর্মীয় পার্টির মধ্যে রয়েছেঃ
১. খৃস্টান পিপলস এ্যালায়েন্স বা Christian Peoples Alliance,
২. দি কমন গুড বা সাধারণ ভালো The Common Good,
৩. অপারেশন খৃস্টান ভোট (Operation Christian Vote) যা বর্তমানে ক্রিশ্চিয়ান পার্টিতে রূপ লাভ করেছে (Christian Party) এই পার্টিটির নেতা রেভারেণ্ড জ র্জ হারগ্রিয়াভেস এবং ডেভিড ব্রায়াড।
৪. খৃস্টান গণতান্ত্রিক দল, Christian Democratic Party (UK)
জার্মানিতে ধর্মীয় পার্টি খৃস্টান কেন্দ্র বা Christian Centre (CM) । ইটালিতে ১৯৪৫ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত খৃস্টান গণতান্ত্রিক পার্টি (Christian Democracy) ক্ষমতায় ছিলো আর ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি ছিলো প্রধান বিরোধী দল।
ফ্রান্সে আগের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজির ইউনিয়ন ফর এ পপুলার মুভমেন্ট বা Union Pour Une Mouvement Populaire (UMP)পার্টিটিকেই মধ্য-ডানপন্থি রক্ষণশীল পার্টি হিসেবে সারা বিশ্ববাসি মনে করে।
ইদানীংকালে বিশ্বব্যাপী সবুজ পার্টিসমূহ নামের পরিবেশবাদী পার্টিগুলো সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ ওয়ার্ল্ডওয়াইড গ্রিন পার্টিস সম্প্রতি গ্লোবাল গ্রিনস প্রতিষ্ঠা করেছে। দ্য ইউনিভার্সাল পার্টি,দ্য সোস্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল,দ্য লিবারেল ইন্টারন্যাশনাল এবং দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডেমোক্র্যাট ইউনিয়ন, প্রত্যেকটিই লন্ডন ভিত্তিক।
তথ্যসূত্র ও টীকাঃ
১. দেখুন, সোফিয়া খোলোদ, What is What, a concise dictionary of Social and Political terms.
২. লেনিন, ভি আই; কমিউনিজমে বামপন্থার শিশু রোগ, এপ্রিল-মে, ১৯২০, রচনা সংকলন, চার ভাগে সম্পূর্ণ, চতুর্থ ভাগ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা- ৩৭।
৩. এম. আর. চৌধুরী, আবশ্যকীয় শব্দ-পরিচয়; কমলাপুর, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১১।
রচনাকাল ১১ জুলাই, ২০১৪
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।
খুব সুন্দর পোষ্ট। অনেক অনেক ধন্যবাদ।