মনোসমীক্ষণ বা মনঃসমীক্ষণ (ইংরেজি: Psychoanalysis) সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) প্রবর্তিত স্নায়বিক এবং মনোবিকারের বিশেষ নিরাময় পদ্ধতি এবং মনোজগতের বিশেষ বিশ্লেষণ। মনঃসমীক্ষণের মতে, মানুষের মন চেতন ও অচেতনে বিভক্ত। মনের চেতন অংশ সামাজিক বিধি নিষেধের প্রভাবে গঠিত। কিন্তু এই চেতন অংশের পরিমাণ বা পরিধি খুবই অল্প। প্রতি মুহুর্তে মানুষের মনের কামনা বাসনা এবং ঘটনার ঘাত প্রতিঘাত থেকে যত ভাবের সৃষ্টি হয় তার খুব অল্প অংশ চেতনার জগতে অবস্থান করে।
ফ্রয়েডের মতে, যৌন অনুভূতি হচ্ছে ব্যক্তির জীবনের প্রধান উদ্দীপক এবং অনুপ্রেরক। যৌন অনুভূতি বলতে যে কেবল দৈহিক অনুভূতি বুঝায় তা নয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালবাসা, সন্তানের প্রতি মায়ের মমতা, কন্যার উপর পিতার বাৎসল্য, সমাজে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা, সাহসী কাজ সম্পাদন দ্বারা অপরের প্রশংসা অর্জনের সুখানুভূতি প্রভৃতি সবই যৌনানুভূতির প্রকাশ। ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে ব্যক্তির ইচ্ছা, অনিচ্ছা, কামনা, বাসনা প্রয়োজন খুব কমই পূর্ণ হয়। ব্যক্তি সমাজ ও পরিবেশকে দেখে তার নিজের কামনা বাসনার প্রতিরোধী শক্তি হিসাবে। ব্যক্তির অপূর্ণ বাসনা আপাত দৃষ্টিতে মরে গেলেও প্রকৃতপক্ষ এগুলি মরে যায় না। ব্যক্তির মনের অচেতন ভান্ডারে তারা আশ্রয় গ্রহণ করে এবং প্রতিমুহুর্তে নিজেদের তৃপ্তির পথ অন্বেষণ করে। অপূর্ব এবং অবাঞ্চিত কামনা সচেতন এবং পরিচিতভাবে নিজেদের তৃপ্ত করতে পারে না। চেতনা সামাজিক প্রহরী হিসেবে অচেতনের দ্বারে প্রহরারত থাকে।
ফ্রয়েডের মতে, অবদমিত অপূর্ণ কামনা নিরন্তর চেষ্টা করে প্রহরী চেতনার চোখকে ফাঁকি দিয়ে অচেতনের বদ্ধ গুহা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়াদিকে ভর করে নিজেদের তৃপ্ত করতে। যে কামনা স্বাভাবিকভাবে তৃপ্ত হতে পারে নি, সে কামনাই ব্যক্তির স্বরূপে কিংবা অরূপে, ব্যক্তির স্নায়বিক বিকারে আত্মপ্রকাশ করে এবং তৃপ্ত হতে চায়।
মনঃসমীক্ষণে মানসিক বিকার মুখ্য বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। মানসিক বিকার নিরাময়ের প্রধান পদ্ধতি হিসাবে মনঃসমীক্ষণ রোগীর স্বতঃস্ফূর্ত এবং অবাধ স্মৃতিচারণের উপর জোর দেয়। মনঃসমীক্ষণবাদের মতে মনোবিকারের মূল কারণ অতৃপ্তি এবং অবদমন। কাজেই নিরাময় হিসাবে প্রয়োজন হচ্ছে অবদমিত কামনাকে ব্যক্তির চেতনার মধ্যে ফিরিয়ে আনা। ব্যক্তির চেতনা নিজের কামনাকে অবদমনের ফলে চিনতে না পারার কারণিই নিজের কামনার প্রকাশের সঙ্গে ব্যক্তির বিরোধ বাধে; ব্যক্তি তাকে সচেতনভাবে না স্বীকার করতে পারে, না তাকে নিজের স্নায়ুকোষ হতে বিতাড়িত করতে পারে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত স্মৃতিচারণের মাধ্যমে ব্যক্তি যদি দেখতে পায় যে, যে কামনাকে সে আবাঞ্চিত ও বৈরী কামনা বা শক্তি বলে মনে করছে সে কামনা তারই প্রয়োজনের সৃষ্টি, তা হলে এই স্বীকৃতিই অতৃপ্ত কামনার তৃপ্তি ঘটাতে সাহায্য করবে এবং ব্যক্তির চেতনার সঙ্গে অবদমিত কামনার বিরোধও দূরীভূত হবে।
এককালে, বিশেষ করে প্রথম মহাযুদ্ধের পরে মনঃসমীক্ষণ বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ব্যক্তির মানসিক জগতের বিশ্লেষণের ফ্রয়েডের বিশেষ অবদানের কথা স্বীকার করেও বলা যায় যে, ফ্রয়েডের এই বিশ্লেষণ প্রধানত ভাববাদী এবং সমাজের বাস্তব অবস্থায় বিবেচনাহীন। ব্যক্তি সামাজিক জীব। সামাজিক পরিবেশ তার কামনা বাসনাকে তৈরি করে এবং তার তৃপ্তি, অতৃপ্তির কারণ হয়। ফ্রয়েডের এ তত্ত্ব ঠিক। এবং এর অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে তাই বলতে হয় যে, মনোবিকারের মূল সমাজ, ব্যক্তির মন নিজে নয়। তাই সামাজিক পরিবেশের আনুকূল্য বা প্রতিকূলতাকে কেন্দ্র ব্যক্তির মনোবিকারের বৃদ্ধি বা হ্রাসের, সৃষ্টি বা নিরাময়ের মূল কারণ এবং উপায় হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
সমাজের সঙ্গে সম্পর্কশূণ্যভাবে ব্যক্তির মনকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে চিন্তা করলে তার বিকারের সার্থক নিরাময়ের চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। সেই কারণে মনঃসমীক্ষণ ও তার প্রাথমিক চমকের পরে আর তেমন কার্যকর অগ্রগতি সাধনে সক্ষম হয় নি। ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণবাদী অনুসারীদের মধ্যে ইয়ং এবং এ্যাডলারের নাম উল্লেখযোগ্য।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৩২৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।