বিজ্ঞান কী? বিজ্ঞান (ইংরেজি: Science) একটি সুসংবদ্ধ উদ্যোগ যা মহাবিশ্ব সম্পর্কে পরীক্ষণমূলক ব্যাখ্যা এবং প্রত্যক্ষণগুলির আকারে জ্ঞানকে তৈরি এবং সংগঠিত করে। বিজ্ঞান হচ্ছে মানব ক্রিয়াকলাপের বহুবিধ ক্ষেত্র এবং সামাজিক চেতনার বিশেষ রূপ।
বিজ্ঞানের লক্ষ্য কী? এটার লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃতি, সমাজ ও চিন্তনের বিষয়বস্তু ও প্রক্রিয়াসমূহ এবং তাদের গুনাগুণ, সম্পর্ক ও নিয়মাবলী অধ্যয়ন করা। বিজ্ঞান শুধু তথ্য ও নিয়মাবলী সম্পর্কে জ্ঞানের সমষ্টি নয়, বরং জ্ঞানের এমন এক সমাহার যা একটি মাত্র ব্যবস্থায় সুসংগঠিত, যেখানে এ সকল তথ্য ও নিয়মাবলী নির্দিষ্ট সম্পর্ক দ্বারা পরস্পরের সংগে জড়িত এবং একটি অপরটির শর্ত হিসেবে প্রকটিত।[১]
বিজ্ঞান একটি সুশৃঙ্খল, সুসংগঠিত বিশেষ জ্ঞানের সমষ্টি যার মধ্যে রয়েছে তত্ত্ব, তথ্য সূত্র ইত্যাদি। এই জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া যেমন-ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, অনুমান, ভবিষ্যৎবাণী, সংখ্যার ব্যবহার, যুক্তি প্রমাণ, গ্রাফ, ছবি, চিত্র, পরিমাপ ইত্যাদি দক্ষতা। বিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যবহারিক কাজের ফলাফল দ্বারা স্বীকৃত অথবা বাস্তবসম্মত যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত। এর মাধ্যমে উপরোল্লিখিত নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক দক্ষতা অর্জন ও বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞান একজন মানুষের মধ্যে বাস্তবসম্মত মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সুতরাং বিজ্ঞান হলো জ্ঞানার্জন অর্জনের প্রক্রিয়া এবং একটি বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি।
বিজ্ঞানের ইতিহাস
মূল নিবন্ধ: বিজ্ঞানের ইতিহাস হচ্ছে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানের চর্চা
মানব সভ্যতায় বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে কোন না কোনভাবে বিজ্ঞানের ব্যবহার চলে আসছে। মানুষের উদ্ভাবনী চিন্তা ও তার প্রয়ােগ যদি বিজ্ঞানের জন্মদাত্রী হয়, তা হলে প্রাগৈতিহাসিক কোনও মানুষ যে দিন প্রথম পাথর ঘষে অস্ত্র বানিয়েছিল বা কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালিয়েছিল, সে দিন থেকেই বিজ্ঞানের সূচনা।[২] কখনো প্রয়োজন, কখনো অনুসন্ধিৎসা মেটানোর জন্য বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার ঘটেছে; আবার কখনো বা আকস্মিকভাবে ঘটেছে। বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা লাভ করেছি বিশ্বজগৎ সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি এবং পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের বিপুল ক্ষমতা।
প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ আগুনের ব্যবহার জানত না, তাই কাঁচা মাংস খেত। এমনকি কাপড়-চোপড়ের ব্যবহার না জানা থাকায় লজ্জ্বা নিবারণের জন্য মানুষ ব্যবহার করত গাছের পাতা বা বাকল। কালক্রমে মানুষ পাথরের ঘর্ষণে আগুন জ্বালাতে শেখে, আরও শেখে পাথরকে শান দিয়ে ধারালো অস্ত্র বানাতে, তখন থেকে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু। পরবর্তীতে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে সাথে মানুষ নিত্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়েছে, পরিবর্তন এনেছে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার সামগ্রীরও।
চাকার উদ্ভাবন বা কৃষির প্রচলন সভ্যতা তথা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক একটি বিরাট পদক্ষেপ। কিন্তু সেই ইতিহাসের অনেকটাই অজানা। যেমন অজানা সেই সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রপথিক ছিলেন কারা। মানবেতিহাসে প্রাচীনতম যে সময়ের হিসাব পাওয়া যায়, সেটি হলো খ্রিস্টপূর্ব ৪২৫০ অব্দ, মিশরীয় ক্যালেন্ডারের যখন সূচনা হয়। সেই সময়ে ভারতে সিন্ধু সভ্যতা এবং তার সাড়ে সাতশাে বছরের মধ্যে এশিয়ার ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর অববাহিকায় মেসােপােটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক যেখানে) সুমেরু সভ্যতা মাথা তুলেছে। ধাতু নিষ্কাশন, মৃৎশিল্প ও নগর নির্মাণে সিন্ধু সভ্যতার দারুণ সব কাজ এবং ভাষা সৃষ্টি ও স্থাপত্যে সুমেরীয়দের দক্ষতা বিস্ময়কর।[২]
অন্য দিকে, ২০০০-১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নীল নদের অববাহিকায় মিশরীয় বিজ্ঞানের উত্থানও চমকপ্রদ। রসায়নে মিশরীয়দের দক্ষতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মমি। সহস্রাধিক বছরের ব্যবধানে যে মৃতদেহে আজও পচন ধরেনি, তাদের আবিষ্কৃত আশ্চর্য সব রাসায়নিকের গুণে। নির্মাণশিল্পে তাদের অসাধারণ দক্ষতার নজির আকাশচুম্বী সব পিরামিড।[২]
সামন্তযুগে বিজ্ঞান
৩৭৫ থেকে ৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের অভিবাসন কালের পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণে চতুর্থ শতকে ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলে একটি মনীষাগত বুদ্ধিবৃত্তিক পতন ঘটেছিল। বিপরীতে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আগ্রাসিদের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিল এবং শিক্ষাকে সংরক্ষণ ও উন্নত করেছিল। পঞ্চম শতকে বাইজেন্টাইন পন্ডিত জন ফিলোপোনাস এরিস্টটলের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষা এবং এর ত্রুটিগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের এরিস্টটলীয় নীতি সম্পর্কে জন ফিলোপোনাসের সমালোচনা মধ্যযুগের পণ্ডিতদের পাশাপাশি গ্যালিলিও গ্যালিলির কাছে অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল। গ্যালিলিও দশ শতাব্দী পরে বিজ্ঞানের বিপ্লবকালে এরিস্টটলীয় পদার্থবিজ্ঞানের ত্রুটিযুক্ত হওয়ার কারণটি খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে ফিলোপোনাসকে তাঁর রচনায় ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত করেছিলেন।[৩]
বিজ্ঞানের শাখা
আধুনিক বিজ্ঞান সাধারণত দুইটি প্রধান শাখায় বিভক্ত যা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান এবং প্রথাগত বিজ্ঞান নিয়ে গঠিত। এই শাখাগুলির প্রত্যেকটিতে বহুবিধ বিশেষায়িত বৈজ্ঞানিক শাখা রয়েছে যা প্রায়শই নিজস্ব নামকরণ-পদ্ধতি এবং দক্ষতার অধিকারী। প্রাকৃতিক এবং সামাজিক উভয় বিজ্ঞানই প্রায়গিক বিজ্ঞান, কারণ তাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতাজনিত পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং একই শর্তে কাজ করে এমন অন্যান্য গবেষকরা এর বৈধতার পরীক্ষা করতে সক্ষম হন।
আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত কিছু শাখা রয়েছে যেগুলো বিজ্ঞান ব্যবহার করে, যেমন প্রকৌশল এবং চিকিৎসাশাস্ত্র, এগুলোকে কখনও কখনও প্রায়োগিক বিজ্ঞান হিসাবে বর্ণনা করা হয়। বিজ্ঞানের শাখাগুলির মধ্যে সম্পর্কের সংক্ষিপ্তসার নীচে দেওয়া আছে।
প্রথাগত বিজ্ঞান
অভিজ্ঞতামূলক বিজ্ঞানসমূহ
প্রাকৃতিক বিজ্ঞান
সামাজিক বিজ্ঞান
ভিত্তি
যুক্তিবিদ্যা; অংক; পরিসংখ্যান
পদার্থবিজ্ঞান; রসায়ন; জীববিজ্ঞান;
পৃথিবী বিজ্ঞান; মহাকাশ বিজ্ঞান
অর্থনীতি; রাষ্ট্রবিজ্ঞান;
সমাজবিদ্যা; মনোবিজ্ঞান
প্রয়োগ
কম্পিউটার বিজ্ঞান
প্রকৌশল; কৃষি বিজ্ঞান;
ঔষধ; দন্তচিকিৎসা; ঔষধালয়
ব্যবসা প্রশাসন;
আইনশাস্ত্র; শিক্ষাবিজ্ঞান
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
বৈজ্ঞানিক গবেষণা মৌলিক বা প্রায়গিক গবেষণা হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। মৌলিক গবেষণা হলো জ্ঞানের সন্ধান এবং প্রায়োগিক গবেষণা হলো গবেষণার জ্ঞান ব্যবহার করে ব্যবহারিক সমস্যার সমাধানের সন্ধান। যদিও কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা নির্দিষ্ট সমস্যাগুলিতে গবেষণাকে প্রয়োগ করা হয়, তবুও আমাদের বোধশক্তির অধিকাংশ আসে বুনিয়াদি গবেষণার কৌতূহল-চালিত উদ্যোগ থেকে। এটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বিকল্পগুলির দিকে নিয়ে যায় যা পরিকল্পিত বা কখনও কখনও কল্পনাও করা হয়নি। “মৌলিক গবেষণার ব্যবহার কী?” এমন প্রশ্নের জবাবে মাইকেল ফ্যারাডে এই বক্তব্যটি তৈরি করেছিলেন? তিনি জবাব দিলেন: “স্যার, নতুন জন্ম নেওয়া সন্তানের কী ব্যবহার?”
বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়
বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় হচ্ছে তাদের নিজ নিজ সমাজ এবং সংস্থাসহ সমস্ত পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় ফলে উদ্ভূত বিজ্ঞানীদের একটি দল। বিজ্ঞানী, নারী বিজ্ঞানী এবং শিক্ষিত সমাজ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
তথ্যসূত্র:
১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১১১-১১২।
২. বিমল বসু, বিজ্ঞানে অগ্রপথিক, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৩।
৩. Lindberg, David C. (2007). “Roman and early medieval science”. The beginnings of Western science: the European Scientific tradition in philosophical, religious, and institutional context (Second ed.). Chicago, Illinois: University of Chicago Press. pp. 132–162. ISBN 978-0-226-48205-7.
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।