আইন অমান্য আন্দোলন (Civil disobedience movement) হচ্ছে আন্দোলনের একটি প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী ধারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতিবাদী দার্শনিক হেনরি ডেভিড থােরাে (১৮১৭-৬২) তাঁর ‘অন দ্য ডিউটি অব সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স’ (১৮৪৯) নামে একটি প্রবন্ধে গণপ্রতিবাদ ও আন্দোলনের এই পদ্ধতিটি তুলে ধরেন। যে-সরকার ক্রীতদাস প্রথা অনুমােদন করে সে সরকারকে কর না দেবার সিদ্ধান্তকে তিনি ওই প্রবন্ধে ব্যক্ত করেন।
উল্লিখিত প্রত্যয়টিকে ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী নেতা মোহনদাস গান্ধী তার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপায়িত করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় জোহান্সবার্গে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে গান্ধীর নেতৃত্বে নানা বিষয়ের প্রতিবাদে সর্বপ্রথম সত্যাগ্রহ ও কিছুটা আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়ে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি চলেছিল। দ্বিতীয়বার তিনি আইন অমান্য পরিচালনা করেন ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯১৯ খ্রি রাউলাট আইনের প্রতিবাদে। বই ও পত্রপত্রিকার নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে অসহযােগ আন্দোলনের গােড়াতে গান্ধী গুজরাতের বড়দৌলি তালুকে আইন অমান্যের সিদ্ধান্ত ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে লেখা এক চিঠিতে ভাইসরয়কে জানিয়ে দেন। কিন্তু চৌরিচৌরায় হিংসাত্মক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উভয় আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।
ইংরেজ সরকার ভারতে শাসনতন্ত্রের মূল্যায়ন ও নতুন বিধিব্যবস্থা প্রবর্তনকল্পে সাইমন কমিশন (১৯২৭) নিয়ােগ ও গােল টেবিল বৈঠকের আয়ােজনে ক্রমে অগ্রসর হতে থাকলে সেই সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তার লাহাের অধিবেশনে (১৯২৯) পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যের প্রস্তাব গ্রহণ করে। কংগ্রেস গান্ধীকে এই দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনের জন্যে দায়িত্ব অর্পণ করে। গান্ধী তার রীতি অনুযায়ী ভাইসরয়ের কাছে লেখা কয়েকটি দাবি সমন্বিত এক পত্রে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। দাবিসমূহ প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল গান্ধী সমুদ্রকূলে ডাণ্ডি নামক স্থানে ৭৯ জন সহকর্মীকে নিয়ে লবণ আইন ভঙ্গ করেন। ক্রমে সেই আন্দোলন দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে বিদেশি পণ্য বয়কট, পিকেটিং, সভাসমিতির আয়ােজন যুক্ত হয়।
সরকারও আন্দোলনে ব্যাপক দমননীতি গ্রহণ করে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মার্চে ভাইসরয় আরউইনের সঙ্গে গান্ধীর এক চুক্তির ফলে আন্দোলন স্থগিত থাকে। গান্ধী গোল টেবল বৈঠকে যােগদান করেন। তাতে কোনও রাজনৈতিক মীমাংসা না হওয়ায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস থেকে আন্দোলন নতুন উদ্যমে শুরু হয়। গান্ধী সহ বহু নেতা ও কর্মী কারারুদ্ধ হন। ১৯৩৪ খ্রি কংগ্রেস অধিবেশনে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।